পাঠ্যবই কেলেঙ্কারিতে ও প্রশ্নফাঁসে প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষা 

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য |

পাঠ্যবই কেলেঙ্কারি দিয়ে বছর শুরু করে ‘ঘুষ’ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বিতর্কিত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে শিক্ষাঙ্গনের ২০১৭ সাল শেষ হচ্ছে। বছরজুড়ে দুর্নীতি-অনিয়ম, শিক্ষক আন্দোলন, স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মেনে স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে দেখা গেছে, বিদায়ী বছরে শিক্ষাঙ্গনের সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় ছিল ‘প্রশ্নফাঁস’। পরীক্ষার আগে ফাঁস করা প্রশ্ন দেখার জন্য ‘গুগলের’ নিউজ বিভাগে সবচেয়ে বেশি খোঁজা হয়েছে ‘জেএসসি কোয়েশ্চেন্স’। এ থেকেই বোঝা যায় ২০১৭ সালে প্রশ্নফাঁস মহামারি আকারে ছড়িয়েছিল। সবমিলিয়ে এই বছরে মৌলিক কোনো কাজ করতে পারেনি। ২০১৭ সাল ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য কছিন সময়। বছরজুড়ে মন্ত্রণালয়টিকে নিয়ে এবার বিতর্ক হয়েছে বেশি। বছরের শেষ দিকে এসে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবির বিষয়টিও নানা মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণায়ের বছরজুড়ে খুব একটা বদনাম না থাকলেও কাজে কোনো গতি ছিল না। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১৭ সাল থেকে বিসিএস নন-ক্যাডারে যারা মনোনীত তাদের মধ্য থেকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। একইসঙ্গে প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষক পদে চলতি দায়িত্ব দেয়া নিয়ে পদোন্নতির কর্মকাণ্ড ঠিকঠাকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সবসময়ই তাদের মধ্যে ছিল ঢিলেমিভাব। বছর শেষে এসে শিক্ষকদের আন্দোলনেও মন্ত্রণালয়টি সংকটে পড়ে। কয়েকদিন পরেই বছর শেষ হলেও এখন পর্যন্ত বছরটির কর্মকাণ্ড নিয়ে স্বমূল্যায়ন করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এই পথে হাঁটেনি। এমনকি এসব বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলতেও চাননি।

বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, বছরের শুরুতেই পাঠ্যপুস্তক বিতরণের মাধ্যমে আনন্দ করতে চাইলেও কেলেঙ্কারির জন্য তা ¤øান হয়ে যায়। ২০১৭ সালের পাঠ্যবইয়ে প্রগতিশীল বহু লেখকের লেখা বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িকীকরণ হয়। এখনও পাঠ্যবই সংকটমুক্ত হয়নি। এছাড়াও পাঠ্যপুস্তকে ভুল বছরের শুরুতেই ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। বছরের ৫ মাস পর এসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঠ্যবইয়ের ভুল সংশোধনে একটি সংশোধনী দেয়।

বছরের প্রথমদিনে বিনামূল্যে বই বিতরণ একটি অন্যতম সফলতা। আগে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যের বই দেয়া হলেও এখন দশম শ্রেণি পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব বইয়ের কাগজ, মুদ্রণ, বাঁধাই নি¤œমানের। এনসিটিবিতে বইকেন্দ্রিক একটি চক্র গড়ে উঠেছে। বইকেন্দ্রিক যত দুর্নীতি করা যায় চক্রটি তার সবই করছে। এ নিয়ে টিআইবি গবেষণাও করেছে। গত ১৩ নভেম্বর প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে এনসিটিবিতে। পাঠ্যবই ও কারিকুলাম রচনা, কাগজ কেনা ও মুদ্রণের টেন্ডারসহ ১৬ ধাপে ১৭ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে থাকে।

শিক্ষা প্রশাসনে অনিয়ম-দুর্নীতি, হয়রানি, ভোগান্তি ও ঘুষ বাণিজ্য ছিল বেপরোয়া। মন্ত্রী ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বললেও সেবাপ্রার্থীদের কষ্ট লাঘব হয়নি। কলেজ শিক্ষকদের বদলির ক্ষেত্রে সিণ্ডিকেট মাথাচড়া দিয়ে ওঠেছে। এমনও দেখা গেছে, কোনো শিক্ষক বদলির জন্য আবেদন দিয়ে গেছেন। কিন্তু পরে সেই আবেদন হারিয়ে যায়। মূলত সিণ্ডিকেটের কারণে কলেজ শিক্ষকদের ভোগান্তি পেতে হয়েছে বেশি। মন্ত্রণালয় এই সিণ্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, একজন কর্মকর্তা শিক্ষা বিভাগে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। অসাধু কর্মকর্তারা সেই সিন্ডিকেটের সদস্য। সিন্ডিকেটটি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ), শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি), পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), বিভিন্ন প্রকল্প, বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডে রাজত্ব কায়েম করে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ২০১৭ সালে নানা কারণে বিতর্কিত হয়েছে শিক্ষা খাত। শিক্ষা বিভাগের কাজের মূল কেন্দ্রবিন্দু শিক্ষা ভবন। সেখানে মাউশি, ডিআইএ, ইইডি এবং বিভিন্ন প্রকল্পের অফিস আছে। ঘুষ ও শিক্ষকদের হয়রানির অভিযোগে মাউশিতে বিভিন্ন সময়ে ঝটিকা অভিযানও চালিয়েছেন মন্ত্রী। কিন্তু ফলাফল ‘অশ্বডিম্ব’।

বছরজুড়ে বেশি আলোচিত ছিল প্রশ্নফাঁস। সর্বশেষ প্রথম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। বছরের শুরুতে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অস্বীকার করেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের আন্দোলনের কারণে মন্ত্রণালয় প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি ধীরে ধীরে স্বীকার করতে শুরু করে। প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয় মন্ত্রণালয়। এমনকি বেশ কয়েকজন শিক্ষকও ধরা পড়েন। কিন্তু প্রশ্নফাঁস ঠেকানো যায়নি। বরং বছরজুড়ে দেখা গেছে, পরীক্ষার আগেরদিন প্রশ্নফাঁস যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। একপর্যায়ে শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে অসহায়ত্বও প্রকাশ করেন। মন্ত্রীর অসহায়ত্ব প্রকাশের জেরে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তার পদত্যাগ দাবি করেন।

সুশীল সমাজের পাশাপাশি দুদকও শিক্ষা বিভাগ নিয়ে বছরজুড়ে কাজ করছে। গত ১৩ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তারা একটি প্রতিবেদন পাঠায়। তাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট বা গাইড, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজে স্বচ্ছতা, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলিসহ শিক্ষা খাতে নানা ধরনের দুর্নীতির উৎস বন্ধের জন্য সুনির্দিষ্ট ৩৯টি সুপারিশ করা হয়। দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান টিআইবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও গবেষণা করে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন, ভিসি নিয়োগসহ শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন কাজে লেনদেন ও দুর্নীতির খতিয়ানসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাতে ধাপে ধাপে দুর্নীতি অনিয়মের তথ্য তুলে ধরা হয়।

দেশের প্রত্যেকটি উপজেলায় সরকারি স্কুল-কলেজবিহীন উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ হচ্ছে। কিন্তু সারাদেশে জাতীয়করণ হওয়া স্কুল ও কলেজের কাজেও রয়েছে নানা দুর্নীতি। শিক্ষকদের ভোগান্তি ও ঘুষ বাণিজ্যের শিকার হতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। সারাদেশে জাতীয়করণ হওয়া ২৮৩টি কলেজের শিক্ষক কর্মচারীদের আত্মীকরণের বিষয়ে বর্তমানে সংকটে রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অতীতে কলেজ জাতীয়করণ হলেই কাম্য যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে শিক্ষক-কর্মচারীরা বিসিএস ক্যাডার হিসেবে আত্মীকৃত হতেন। কিন্তু এবার ২৮৩টি কলেজ জাতীয়করণের পর শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্মীকরণ করতে সরাসরি বাধা দেয় বিসিএস শিক্ষা সমিতি। সরকারি কলেজ শিক্ষকদের সংগঠনের নাম বিসিএস শিক্ষা সমিতি। আত্মীকৃত শিক্ষকদের বিসিএস ক্যাডার করা যাবে না দাবি জানিয়ে সরকারি কলেজ শিক্ষকরা আন্দোলনে নামেন। তাদের আন্দোলনে কলেজ শিক্ষা টালমাটাল হয়ে যায়। বিষয়টির এখনও সুরাহা হয়নি।

সৌজন্যে: ভোরের কাগজ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024950504302979