পাঠ্য বইয়ের ভুল ও প্রতিকার অনুসন্ধান

ড. মো. নাছিম আখতার |

ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায় যে ইংল্যান্ডের মতো একটি মাঝারি আয়তনের দেশ সারা বিশ্ব শাসন করেছে। এর পেছনে যদি আমরা কারণ খুঁজি তাহলে দেখব যে সেই সময়ে গবেষণা ও শিক্ষার প্রসার তাদের দেশ জয়ে অগ্রগামী করেছে।

অক্সফোর্ড আর কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি হয়েছে তাদের দেশ জয় শুরুর অনেক আগেই। শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নই হচ্ছে উন্নত দেশ গঠনের মূল উপাদান।
স্কুল ও কলেজ জীবনে পাঠ্য বই থেকে জ্ঞান অর্জিত হয়। সেখানে যদি ভুল থেকে যায়, তাহলে সেই ভুল দেশের সব ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে মহামারির মতো সংক্রমিত হয়ে ভুলই প্রতিষ্ঠিত হয়—বিষয়টি আমরা ভেবে দেখেছি কি? দুর্বল ভিত্তি বা ভুল ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা যুবসমাজ কি পারবে দেশকে বদলে দিতে! শিক্ষার্থীদের ভুল শেখার যে মাধ্যম সেই পাঠ্য বই যাঁরা প্রণয়ন করেছেন তাঁরাও কি পারবেন এর দায়িত্ব এড়াতে? দিন যত যাচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে তত বেশি জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে আগে প্রবাসজীবনে মানুষ যত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত এখন করে না, ভবিষ্যতে আরো বেশি অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। তাই নিজের দেশকে গড়ে নিয়ে এখানেই ভালো থাকার চেষ্টা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ।

যেকোনো দেশের অগ্রগতির মূল উপাদান হচ্ছে শিক্ষা ও গবেষণা। গবেষণাকে ত্বরান্বিত করতে চাই মানসম্মত ও দুর্নীতিমুক্ত নির্ভুল শিক্ষা। এই নির্ভুল শিক্ষার নিশ্চয়তা দেবে সরকার, তথা সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, যাঁরা সরকার পরিচালনায় প্রত্যক্ষ অংশীদার এবং বই মুদ্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত।

আমার ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তার কৃষিশিক্ষা বইটি পড়ানোর সময় দেখলাম ৯ পৃষ্ঠায় লেখা আছে ভারত বাংলাদেশের প্রায় ২৮ গুণ। আগের বইয়ে এটি নাকি ৫১ গুণ ছিল। সংশোধন করে পরের ভার্সনে ২৮ গুণ করা হয়েছে। আমরা জানি, ভারতের আয়তন ৩২,৮৭,০০০ বর্গকিলোমিটার আর আমাদের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার। ভারতের আয়তনকে আমাদের আয়তন দিয়ে ভাগ করলে আমরা পাই ২২.২৭ অর্থাৎ ভারত আমাদের ২২.২৭ গুণ বা ২২ গুণ (প্রায়)। একে কিভাবে প্রথমে ৫১ গুণ আর সংশোধনীর পরে ২৮ গুণ দেখানো হলো তা বোধগম্য নয়। এটা কর্তৃপক্ষই ভালো বুঝবে। এবার পরীক্ষায় যদি বহু নির্বাচনী প্রশ্নে ‘ভারত বাংলাদেশের কত গুণ?’—এ প্রশ্নটি আসে, তাহলে সঠিকটা জেনেও ছেলেকে ২৮ গুণেই টিক দিতে বলতে হবে। কারণ যেহেতু বইয়ে লেখা আছে, তাই বইয়েরটা ভুল হলেও শুদ্ধ। বইয়ের বদৌলতে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভুলটায় টিক দিতে বাধ্য। এ ধরনের ভুল অতি সত্বর সংশোধন করা উচিত।

আবার কৃষিশিক্ষার ৮৭ পৃষ্ঠার নিচের দিক থেকে দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনে অসামঞ্জস্য রয়েছে। চতুর্থ লাইনে শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে পুকুরে ৭-১০ সেমি আকারের মাছের পোনা প্রতি শতকে মজুদ করা যায় ২৫-৪০টি। কিন্তু পরক্ষণেই দ্বিতীয় লাইনে বিভিন্ন মাছের পোনা সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সংখ্যার যোগফল পাওয়া যায় ২৪-৪০টি। প্রশ্ন থেকে যায়, দুই লাইনের ব্যবধানে একটি মাছের পোনা কোথায় হারাল? এখানেও প্রদেয় তথ্যের মধ্যে সংখ্যাগত ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এ অংশ থেকে সৃজনশীল প্রশ্নে প্রশ্ন করতে দেখেছি। এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে বইয়ের ভুল তথ্যই শিক্ষার্থীকে তুলে ধরতে হবে। যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঠিক জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে দোদুল্যমান মানসিক অবস্থায় পর্যবসিত করে। সুতরাং এখানেও জরুরি ভিত্তিতে সংশোধনীর প্রয়োজন রয়েছে।

এবার আসছি চতুর্থ শ্রেণির গণিত বইয়ের একটি যুক্তিগত ভুলের বিষয়ে। ৬.৪ অনুশীলনীর ৫ নম্বর প্রশ্ন্ন : (খালি ঘর) ব্যবহার করে নিচের সমস্যাগুলোকে প্রকাশ করো এবং অজানা সংখ্যাটি নির্ণয় করো। এর ১ নম্বর উপপ্রশ্ন নিম্নরূপ—

(১) একটি সংখ্যাকে ৭ দ্বারা ভাগ করলে ভাগফল ৫ ও ভাগশেষ ৭ হয়।

ভাজক ৭ হলে ভাগশেষ কিভাবে ভাজকের সমান হয় তা আমার জানা নেই। ভাগফল যদি পূর্ণসংখ্যা হয় তাহলে ভাগশেষ ০-৬ পর্যন্ত যেকোনো সংখ্যা হবে।

একজন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী এই প্রশ্ন দেখলে যৌক্তিক ভুলের বিষয়টি তার মাথায় আসবে না। সে ভাববে প্রশ্ন হয়তো ঠিকই আছে। এই ধরনের ভুলকে ঠিক ভাবতে শেখা তার জ্ঞানের উন্মেষকে এমনভাবে বাধাগ্রস্ত করবে যে তার আর গণিত বুঝে করার ক্ষমতা অর্জিত হবে না। সে হয়তো বাংলা, ইংরেজির মতো অঙ্ক মুখস্থ করবে। যে জাতি গণিতে যত ভালো, সেই জাতির উন্নতির সম্ভাবনাও তত বেশি। কারণ জীবনের সব কর্মকাণ্ডের গাণিতিক মডেল তৈরি করা যায়। এই গাণিতিক মডেলই বিজ্ঞান ও গবেষণার প্রধান শক্তি। সুতরাং এ ধরনের যুক্তিগত ভুল আমাদের পাঠ্য বইয়ে কাম্য নয়। এ ধরনের ভুল সংশোধন শিক্ষার্থী মেধার উন্মেষকে ত্বরান্বিত করবে।

এবার আসছি ভুল থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? কোনো বই রচনার ক্ষেত্রে লেখককে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া উচিত। যেহেতু বইগুলো সব বাংলায়, তাই বোর্ডের সব শ্রেণির বইয়েই যেন উচ্চারণ ও বানান নির্ভুল ও একই থাকে—বিষয়টি নিশ্চিত করা। এটা করতে হলে প্রতিটি বইয়ের সম্পাদকদের মধ্যে একজন বাংলার পণ্ডিত ব্যক্তি থাকতে হবে। প্রতি শ্রেণির প্রতিটি বইয়ের ক্ষেত্রেই একটি নিবিড় পর্যবেক্ষণ কমিটি থাকবে। এই কমিটি হতে পারে শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে, যাঁরা সর্বাগ্রে চিন্তা করবেন দেশ ও জাতির উন্নতি। সর্বোপরি পাঠ্য বই প্রণয়ন, সম্পাদন ও মুদ্রণের ক্ষেত্রে অতিসচেতন থাকতে হবে। তবেই আমরা পারব আমাদের এই অনভিপ্রেত ভুলগুলোকে সমাধান করে জাতিকে সুন্দর ও মানসম্মত বই উপহার দিতে।

লেখক : অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও পরিচালক (কম্পিউটার সেন্টার), ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025091171264648