করোনাভাইরাস সারাবিশ্বকে গ্রাস করছে। মহামারী আকার ধারণ করেছে। ঘরে থাকাই সর্বোত্তম পন্থা। বেশিরভাগ দেশেই আংশিক বা পুরোপুরি লকডাউন চলছে। বাংলাদেশকেও প্রায় স্থবির করেছে এ অদৃশ্য শক্তি। অর্থনীতির সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত। শিক্ষাখাতও ক্ষতিগ্রস্ত। সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারপরেও অন্যদেশের ন্যায় আমরাও পিছিয়ে যাচ্ছি। সব ক্ষেত্রে। স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে খোলা যাবে তা বলা যায় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। তিনি শিশু-কিশোরদের সংকটের দিকে ফেলে দিতে চান না। তিন চান না ভবিষ্যতের প্রজন্মের কেউ দুর্বল হয়ে বেড়ে উঠুক। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। এ বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। শুক্রবার(১৫ মে) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত উপ-সম্পাদকীয়তে তথ্য জানা যায়।
উপ-সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, বাংলাদেশে ১ এপ্রিল থেকে যে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল, তা স্থগিত করা হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রমও দেরিতে শুরু হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামার সেমিস্টারের ভর্তিও স্থগিত করা হয়েছে। ফলে করোনাভাইরাসে চলমান সাধারণ ছুটির কারণে পাঁচটি পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আগেই স্থগিত করা হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষা। নভেম্বরে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী (পিইসি-জেএসসি) পরীক্ষা হওয়ার কথা। বলা যায়, এ তিনটি পাবলিক পরীক্ষা হুমকির মধ্যে পড়েছে। আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। স্কুলের বিভিন্ন সাময়িকী পরীক্ষা নিয়েও চিন্তিত। ইতোমধ্যে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। কলেজ-ভার্সিটির ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। সবরকমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস বন্ধ রয়েছে। বিকল্প পথ হতে পারে সিলেবাস কাটছাঁট বা অটো প্রমোশন। সাময়িক বা বার্ষিক পরীক্ষার বিষয়ে বিকল্পপথ বের করা যাবে। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিকল্প চিন্তার প্রয়োগ করা প্রায় অসাধ্য। কারণ বাংলাদেশে তেমন কোনও পদ্ধতি বের হয়নি। উন্নত দেশের মতো আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষক বা কারিকুলাম দক্ষ বা উন্নত করতে পারিনি। শিক্ষক-প্রশাসনে অনেক ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার প্রশ্ন থেকে যায়। গ্রাম-শহর-স্কুলভেদে একই মানস¤পন্ন শিক্ষকগোষ্ঠী আমাদের নেই। ফলে, যে কোনও অটো প্রমোশনের ক্ষেত্রে যোগ্যতাভিত্তিক ফলাফলের প্রায় সঠিক পদ্ধতি বের করা প্রায় অসম্ভব।
করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় দুইমাস বন্ধ রয়েছে। ছুটি আরও বাড়তে পারে। জুনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা গেলে একটু সহজে সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এখন পর্যন্ত সৃষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী আগামী ৩০ মে পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি থাকছে। এতে আড়াই মাস শ্রেণী কার্যক্রম থেকে শিক্ষার্থীরা দূরে থ্কবে। কিন্তু এরপরও যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়, সে ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হতে পারে। যদি জুনেই শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা যায় তাহলে সংকট আমরা সহজেই উৎরাতে পারা যাবে। কিন্তু জুলাই বা আগস্টে শুরু করতে হলে বা সেটি যদি সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত গড়ায় তাহলে সংকট গভীর হবে। কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে এবং কিছু ঐচ্ছিক ছুটি হ্রাস করে তার কিছুটা পোষানো যাবে। বিশেষ করে জেএসসি পরীক্ষা গ্রহণ এবং ২০২১ সালের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের তেমন একটা ক্ষতি হবে না। বাড়তি ক্লাসের ব্যবস্থা করে যথাসময়ে টেস্ট পরীক্ষা নেয়া যাবে। বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা বা শিক্ষাবিদগণের মত হচ্ছে- ছুটি বেড়ে গেলে বড় সমস্যা হবে জেএসসি-এসএসসি-এইচএসসির পরীক্ষার। এসব পরীক্ষার সিলেবাস ছোট করা যায় না। গোটা বই থেকেই পরীক্ষা নেয়ার স্বার্থে প্রয়োজনে পরীক্ষা পেছাতে হবে। সে ক্ষেত্রে ২৯২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি আর এপ্রিলে এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা বেড়ে যাচ্ছে। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার রেজাল্ট এখনও দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে পরবর্তী ক্লাসের কার্যক্রমও শুরু হচ্ছে না। এর ফলে আগামী বছরের এইচএসসি পরীক্ষা হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে।
উচ্চশিক্ষায়ও সমস্যায় পড়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই শতাধিক পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও সৃষ্টি হয়েছে পরীক্ষাজট। সামগ্রিকভাবে সেশনজটের আশঙ্কা করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে অনলাইন পাঠদান কার্যক্রম জোরদার করা যেতে পারে। কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে সেমিস্টার পাঠদান শেষ করেছে বলে জানা যায়। তবে বিকল্প পরীক্ষাপদ্ধতি না থাকায় পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ জট খুলতে নীতিমালা তৈরি করা দরকার। পদ্ধতি সহজ করে নির্দেশনা দেয়া দরকার।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্কুলেপড়ুয়াদের অনেকে বার্ষিক পরীক্ষা না দিয়েই ‘অটো প্রমোশন’ দিয়ে ওপরের ক্লাসে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে তেমন করা যায়নি। যুদ্ধের সময় যেসব পাবলিক পরীক্ষা হয়েছিল, স্বাধীনতার সময় সেসব পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়া হয়। আইয়ুব আমলে স্নাতক পাস কোর্স তিন বছর থেকে কমিয়ে দুই বছর করতে তৃতীয় বর্ষ স্নাতক পাঠরতদের পরীক্ষা ছাড়াই ডিগ্রি দেওয়া হয়। কিন্তু এ পদ্ধতি নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেছেন। জানা গেছে, অন্যান্য বছরের মতো এবারও স্ব স্ব শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে এসএসসি-সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে। পাশাপাশি টেলিটক মোবাইলের মাধ্যমে এসএমএস করে পরীক্ষা ফল জানা যাবে। তবে ঘরের বাইরে না গিয়ে কীভাবে সহজেই শিক্ষার্থীদের কাছে ফল পৌঁছে দেয়া যায়, সে বিষয়টি নিয়েও শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে এসএমএসে ফল দেয়ার চিন্তা বোর্ডগুলোর আছে।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ৩০ মে পর্যন্ত স্কুল-কলেজ-মাদরাসা ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলসহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বর্তমানে সংসদ টেলিভিশনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণী ক্লাস সম্প্রচার করা হচ্ছে। জানা যায়, টেলিভিশনে পাঠদানকারী শিক্ষক পাঠদান করা বিষয়ের ওপর শিক্ষকরা বাড়ির কাজ দেবেন। শিক্ষার্থীদের প্রত্যেক বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা খাতায় বাড়ির কাজ করতে হবে। স্কুল খুললে তা শিক্ষকদের কাছে জমা দিতে হবে। টেলভিশনের মাধ্যমে পাঠ্যক্রম পরিচালনা করায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ। অনলাইন ক্লাস কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। উন্নত দেশেও আছে। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সমস্যা প্রকট হওয়ারই কথা। কিন্তু সে হিসাবে আমাদের সমস্যা কমই। নেটের সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। সবার জন্য স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য নেই। গরিব ছাত্র-অবিভাবকের জন্য এটি চিন্তার বিষয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে আমরা এখনও তেমন সমৃদ্ধ বেশি কন্টেন্ট প্রস্তুত করতে পারেনি। এক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতাও কম। আর করোনাবিপর্যয়ে আমরা প্রস্তুতও ছিলাম না। তবে এক্ষেত্রে আমাদের অধিক নজর দিতে হবে। পরবর্তীতেও আমাদের অনলাইন কার্যক্রম বেশি পরিমাণে প্রচলন করতে হবে।
করোনাভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার একটি নতুন মোবাইল অ্যাপ চালু করল ভারত সরকার। এই অ্যাপের নাম দেওয়া হয়েছে ‘আরোগ্য সেতু’। কারও স্মার্টফোনে এই অ্যাপ থাকলে লোকেশন ডেটা ও ব্লুটুথের মাধ্যমে জানা যাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছাকাছি কোন করোনা আক্রান্ত আছেন কিনা। যে ব্যক্তি এই অ্যাপ ব্যবহার করছেন, তার সংক্রমণের ঝুঁকি আছে কি না, সেটাও এই অ্যাপের মাধ্যমেই জানা যাবে। এ রকম একটি অ্যাপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বেশ কাজ দেবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরকম একটি অ্যাপ এ মাসের শেষের দিকে ছাড়তে পারে বলে বিবিৃতি দিয়েছে। পাঠদান কার্যক্রম শুরু হলে আমাদের দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে অ্যাপটির পুনঃনির্মাণ করা যেতে পারে বা আলাদা অ্যাপও তৈরি করা যেতে পারে।
করোনার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে গেলে স্কুল-কলেজ খুলে দিয়ে প্রয়োজনে ডাবল শিফটে ক্লাস নিয়ে পড়াশোনার এই গ্যাপ পূরণ করে নেয়া যেতে পারে। অন্যান্য ছুটিও যথাসম্ভব কমিয়ে দিতে হবে। এ বছরের জন্য সীমিত আকারে অন্যান্য সেক্টরের মতো আবশ্যকীয় পালনীয় নির্দেশনা সাপেক্ষে কোচিং সেন্টার খুলে দেওয়া যেতে পারে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরীক্ষা নিয়ে দ্রুত ফলাফল দিতে হবে। পরবর্তী পাঠদান কার্যক্রম যথাসম্ভব দ্রুত করতে হবে। সেই সাথে সময় নষ্ট না করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হবে। ডিসেম্বরের ছুটি কমিয়ে দিতে হবে। শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন থেকেই পুরোদমে পাঠদান শুরু করে দিতে হবে। চলতি বছরের সিলেবাসের কাটছাঁট অংশ পরবর্তী বর্ষে পড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বর্তমান বছরের তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বা পরবর্তী বছরের সিলেবাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা এ বছর বাদ দেওয়া যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বর্ষের মধ্যে প্রায় একই বিষয়ে একাধিক পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তি আছে। পাঠদানে পুনরাবৃত্তি করা যাবে না। শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের ওপর এ দায়িত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ছুটির মধ্যে স্টুডেন্টস-অবিভাবকদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখতে হবে। খোঁজখবর নিতে হবে। সংকটকালে শিশুদের পড়াশোনার অগ্রগতির খোঁজ বা মনিটরিং রাখতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকদের যথেষ্ট সমীহ করে। খোঁজখবর নিলে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হবে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ চর্চার প্রয়োগ বেশি করতে হবে।
লেখক : আবু আফজাল সালেহ, কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট