পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কি জমিদার

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

করোনাকালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীরা, বিশেষ করে উপাচার্যরা স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড চালিয়েই যাচ্ছেন। এ মুহূর্তে অন্তত তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অরাজক অবস্থা চলছে—রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। আজকের লেখায় খুলনা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই থাকবে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে পরে লেখা হবে।  শনিবার (২৩ জানুয়ারি) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়,  এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার প্রকৃতি ও ধরন আলাদা হলেও প্রতিটির সঙ্গে উপাচার্য ও প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতা, দলবাজি, স্বজনপ্রীতি প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় আর পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। জ্ঞানদান ও জ্ঞান সৃষ্টির সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য দলমত-নির্বিশেষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী যে যাঁর অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখবেন, সে রকমই প্রত্যাশিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা উপাচার্য হয়ে আসেন, তাঁরা হাবেভাবে দেখাতে চান, ক্যাম্পাস তাঁর জমিদারি। তিনি ক্যাম্পাসে থাকুন আর না-ই থাকুন, তাঁর কথায় ও অঙ্গুলি হেলনে সবকিছু চলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনকানুন, বিধি–নিয়ম গুরুত্বপূর্ণ নয়; গুরুত্বপূর্ণ হলো তাঁর ইচ্ছা। কোনো কোনো উপাচার্য শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলার চেয়ে চার বছরের ‘জমিদারি’ রক্ষার কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় তিয়াত্তরের বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তার অন্যতম। কিন্তু স্বায়ত্তশাসন মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। উপাচার্য আবদুস সোবহান দ্বিতীয় মেয়াদে আসার পর নিজের পছন্দের লোকদের নিয়োগ দিতে আইন অগ্রাহ্য করে নিয়োগবিধি সংশোধন করলেন। এর প্রতিকার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ দেড়েক শিক্ষক আচার্য ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি লেখেন। ইউজিসির তদন্তে এসব অভিযোগের সত্যতা বেরিয়ে আসে। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত বছরের ১০ ডিসেম্বর উপাচার্যকে কৈফিয়ত তলব করে এবং কিছু নির্দেশনা দেয়। নির্দেশনাগুলো হলো: ১. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগ কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত করা, ২. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের নিয়োগ নীতিমালা বাতিল করে ১৯৭৩-এর আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন, ৩. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়মবহির্ভূতভাবে দখলে রাখা ডুপ্লেক্স বাড়ির ভাড়া ৫ লাখ ৬১ হাজার ৬০০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া এবং ৪. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এম এ বারীকে অসদাচরণের জন্য রেজিস্ট্রার পদ থেকে অব্যাহতি।

ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এম এ বারী পদত্যাগ করেছেন। বাকি কোনো নির্দেশনা উপাচার্য কার্যকর করেননি। এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কৈফিয়তেরও জবাব দেননি। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানেন না, ইউজিসির তদন্তকে চ্যালেঞ্জ করেন।

এদিকে চাকরিপ্রার্থী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দিলে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়ার আশ্বাস দেন। একই ঘটনা ঘটেছে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে আন্দোলনকারীদের ভয়ে উপাচার্যকে রাতের আঁধারে ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। আগে যাঁরা ছাত্ররাজনীতি করতেন, তাঁরা পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখতেন। আর এখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তৃতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য উপাচার্যের কাছে ধরনা দেন, প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফায়েকুজ্জামানের দ্বিতীয় মেয়াদ চলতি মাসের ২৮ তারিখ শেষ হওয়ার কথা। এর মধ্যে তিনি অনেক অঘটনের জন্ম দিয়েছেন। করোনাকালে তিনি তিন শিক্ষকের চাকরি খাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করছেন, দুই শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করেছেন। এর আগে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষককে দেওয়া কারণ দর্শানোর নোটিশে বলা হয়েছিল ‘স্বাভাবিক একাডেমিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত করা, শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অসৌজন্যমূলক আচরণ, প্রশাসনিক ভবন তালাবদ্ধ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আটকে রাখা ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ছিল বেআইনি, অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত।’

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে চারজন শিক্ষকের ‘সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে’ মর্মে ব্যাখ্যা দাবি করা হয়েছে। একটি ঘটনার কোনো রূপ তদন্ত ছাড়াই সংশ্লিষ্টতা ‘প্রতীয়মান হয়েছে’ বলার উদ্দেশ্য কী? সেই চার শিক্ষকের একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকায় তিনি চাকরিচ্যুতি থেকে আপাতত রেহাই পাচ্ছেন। বাকি তিনজনের মাথায় চাকরিচ্যুতির খড়্গ ঝুলছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বেলা দুইটার মধ্যে তিন শিক্ষককে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছিল। শিক্ষকেরা জবাব দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটাই দেখার বিষয়।

গত বছরের ১ ও ২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুচিকিৎসা, সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ, বেতন-ফি কমানো, অবকাঠামো নির্মাণে দুর্নীতির প্রতিকার, শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী অধ্যাদেশের সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। এসব দাবির কোনটি অযৌক্তিক? উপাচার্য কি চান না ক্যাম্পাসে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা হোক? ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের অর্থ এই নয় যে সেখানে কেউ সংস্কৃতি চর্চা করতে পারবেন না। শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁরা কথা বলতে পারবেন না। ১ ও ২ জানুয়ারি যখন শিক্ষার্থীরা হাদী চত্বরে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছিলেন, তখন দুই শিক্ষক কেন সেখানে গাড়ি চালিয়ে গেলেন? কেন বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তাঁরা সেখান থেকে সরে গেলেন না? তাহলে উসকানি কারা দিয়েছেন—আন্দোলনের প্রতি সমর্থনদানকারী চার শিক্ষক, না অবরোধ ভাঙতে আসা দুই শিক্ষক?

অভিযুক্ত দুই শিক্ষার্থী কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে তদন্ত কমিটির কাছে জানতে চেয়েছিলেন অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন কয়েক শ শিক্ষার্থী, তাঁদের মধ্য থেকে দুজনকেই কেন নোটিশ দেওয়া হলো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছে, তঁারা শিক্ষকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। কিন্তু সে জন্য একতরফা শিক্ষার্থীদের দায়ী করা যায় না। অবরোধস্থলে গাড়ি চালিয়ে আসা দুই শিক্ষককেও এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। উপাচার্য ও ওই দুই শিক্ষক যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, তখন তাঁরা ন্যায্য দাবিতে ক্যাম্পাসে কোনো আন্দোলন যোগ না দিলেও নিশ্চয়ই সতীর্থদের আন্দোলন দেখেছেন। দমনপীড়ন বা বহিষ্কারাদেশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিবৃত্ত করা যায় না। তাঁদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নোমানকে এক বছরের জন্য এবং ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ইমামুলকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করেছে। এর প্রতিবাদে তাঁরা গত মঙ্গলবার থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন। ইতিমধ্যে তাঁদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং তাঁকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। অপর শিক্ষার্থীর শারীরিক অবস্থাও অবনতির দিকে। অসুস্থ হয়ে পড়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো ধরনের চিকিৎসা সহায়তা না দেওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পদাধিকারীর সেখানে না যাওয়া অমানবিক। সাধারণ শিক্ষার্থীরাই বাইরে থেকে চিকিৎসক এনে অনশনরত দুই শিক্ষার্থীর চিকিৎসা করিয়েছেন। বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এসে তাঁদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। অনশন কর্মসূচির আগে ওই দুই শিক্ষার্থীর একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার অনশনের খবর শুনে পরিবারের সদস্যদের কিছু হলে তার দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই নিতে হবে।’

সর্বশেষ খবর হলো গতকাল দুপুরে খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা করে তাঁদের বক্তব্য শুনেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গেও তাঁর বসার কথা। হয়তো একটি সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু বিদায়বেলায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফায়েকুজ্জামান যে নজির রেখে গেলেন, তা শিক্ষা ও শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়। গৌরবের তো নয়ই।

লেখক : সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052828788757324