পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য যান, উপাচার্য আসেন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলাদেশে এখন স্বায়ত্তশাসিত ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৯ টি। বর্তমানে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলছে। তার মধ্যে এগিয়ে আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। তিন মাস ধরে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতে থাকা আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণায় এসে ঠেকেছে। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা  যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, যে কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলছে, তার মধ্যে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রশাসনিক ভবনের কর্মকর্তাদের পদত্যাগ দাবি করে আন্দোলন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন দফা দাবিতে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ চলছে। দুই হলের শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার কারণে বন্ধ হয়েছে কুয়েট।

 

এর আগে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। অন্যদিকে বুয়েটে আবরার হত্যার এক মাস পরেও এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। শিক্ষার্থীরা এখনো ক্লাসে ফেরেননি।

কেন এমনটা হচ্ছে? কী সমস্যা আসলে উপাচার্যদের? উপাচার্যরা যেখানে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অভিভাবক, সেখানে শিক্ষার্থী আন্দোলন শেষতক উপাচার্য অপসারণ কিংবা পদত্যাগের দাবিতে ঠেকছে কেন? এই ৪৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য আছেন। এর মধ্যে মাত্র চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত বা ৭৩-এর অধ্যাদেশে পরিচালিত হয়।

এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হওয়ার বিধান। কিন্তু সবগুলোতে এই চর্চা এখন আর নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের নিয়োগ দেয় সরকার। সরকার সরাসরি দলীয়ভাবে যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেয়। এ কারণে এই নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যদের কাজই হয়ে পড়ে সরকারের সব অবস্থানের সঙ্গে একমত পোষণ করা।  মতামত

যার ফলে সরকারের কথামতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালাতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপাচার্যদের মতপার্থক্য তৈরি হচ্ছে। এগুলো প্রভাব ফেলছে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কের ওপর। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁদের এই আস্থার সম্পর্কটির ওপর আর নির্ভর করতে পারছেন না। এই অস্বস্তি, বনিবনা না হওয়া একটা পর্যায়ে এসে আন্দোলনে রূপ নেয়।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার সরাসরি উপাচার্য নিয়োগ দেয়। ছয় মাস শূন্য থাকার পর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চার মাস শূন্য থাকার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও পেল অস্থায়ী থেকে চার বছর মেয়াদি স্থায়ী উপাচার্য।

বর্তমানে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ শূন্য রয়েছে এক মাস ধরে। এ ছাড়া সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ২৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহ-উপাচার্য পদ এবং ১৮ টিতে ট্রেজারার পদ শূন্য আছে। পদ শূন্য থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে যে বিঘ্ন ঘটছে, তা সহজেই অনুমেয়।

এটা খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যরা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কার্যত একক ক্ষমতার অধিকারী। তাঁদের কেউ কেউ কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না এবং তাঁদের একক সিদ্ধান্তেই বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো যে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন উপাচার্য আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন, কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

তাঁদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। কথা হলো, এই উপাচার্যরা কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে অনেকেরই হয়তো ব্যক্তিগত সুনাম আছে। কিন্তু যখনই উপাচার্য হচ্ছেন, তখনই একে একে বিকিয়ে দিচ্ছেন দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনাম-মানসম্মান।

এখন কথা হলো, কেন এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় দরকার? আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক কাঠামোতেই যেখানে এতটা দুর্বলতা রয়েছে কিংবা দাঁড়িয়ে আছে এক ব্যক্তির শাসনের ওপর, তখন সেগুলোকে কি আসলে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে? এখন যদি আমরা হিসাব করি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, ট্রেজারার, সেভাবে ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৭টি পদ।

অনেকেই তো উপাচার্য হতে চান। আবার উপাচার্যের পদ ছেড়ে যুবলীগের দায়িত্ব নিতে চাওয়া উপাচার্যও আছেন। এই ১৪৭টি পদে যেতে বিভিন্নভাবে তদবির করেন হাজারখানেক শিক্ষক। উপাচার্য পদের আশায় তাঁরা তদবিরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কাছে যান, সচিবদের কাছে যান, আবার কখনো কখনো তাঁরা ছাত্রনেতাদের মুখাপেক্ষীও হন। এই পদগুলো কার্যত রাজনৈতিক বিবেচনায় নিলামে তোলা হয়। যদি তা করা না হতো, তাহলে হয়তো এই চিত্র মিলত না।

আর কী কী করেন এই সরকারি উপাচার্যরা? বিভিন্ন অনিয়মের কারণে যখন তাঁকে ঘিরে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, তখনো তিনি নির্ভয়ে থাকেন। বারবার বলতে থাকনে, সরকার না বললে তিনি কিছুই করবেন না, এমনকি আবরার মারা যাওয়ার পরও বুয়েটের উপাচার্য তাঁকে দেখতে আসতে দেরি করেন, কারণ, অভিযোগ আছে তিনি নাকি তখন ওপরের মহলের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যস্ত ছিলেন।

ক্ষমতা এমন এক বিষয় যে সেটি ধরে রাখতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করাতে কিংবা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দিতে উপাচার্যরা যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দেন। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক ও কার্যকর আন্দোলনের সামনে কোনো উপাচার্যের টিকে থাকার ইতিহাস নেই।

কিন্তু তারপরও উপাচার্যরা শেষ দিন পর্যন্ত বিভিন্নভাবে চেয়ারের পায়ায় ক্ষমতার নানামুখী পেরেক ঠুকে ক্ষমতাকে ধরে রাখতে চান। কারণ, তাঁরা মনে করেন তাঁদের ক্ষমতার ভিত্তি দল ও সরকার, শিক্ষার্থী নয়। সরকারের ইচ্ছায় উপাচার্যদের এই আসা-যাওয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রমের বড় সর্বনাশ করে চলেছে।

লেখক : জোবাইদা নাসরীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023610591888428