পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শুরু হয়েছে ভর্তি পরীক্ষার মৌসুম। ভর্তির এই মৌসুমে একজন ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী পরিবারের চিত্র যদি আমরা নিবিড়ভাবে দেখি, তাহলে দেখতে পাব—একজন শিক্ষার্থীর জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া মানে কিছুদিনের জন্য যাযাবর হয়ে যাওয়া। শুধু পরীক্ষার্থী নয়, সঙ্গে তার মা-বাবাকেও বেছে নিতে হয় উদ্বাস্তু জীবন। বাড়ি-ঘর রেখে তারা আজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের কোনো হোটেল নয়তো কাল অন্য কোনো শহরে দূরাত্মীয়র বাসায় উপযাচক হয়ে রাত্রি যাপন করতে বাধ্য হন। আর ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী যদি হন ছাত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। শুক্রবার (৩০ আগস্ট) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন মহিউদ্দীন আহেমদ।

গতবারের সেশনে পরিচিত এক শিক্ষার্থীকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। ভর্তি কোচিং ও ফরম কেনা বাবদ খরচ বাদেও তাকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যেতে তার মাকে প্রায় ৬০ হাজার টাকা গুনতে হয়েছে। এর মধ্যে হোটেল ও গাড়িভাড়া বাবদই খরচ হয়েছে বেশিরভাগ টাকা। শুধু তা-ই নয়, ছাত্রীটির অসুস্থ ছোটো ভাইটিকে ঘটনাক্রমে কয়েক ঘণ্টার জন্য কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের ফুটপাতেও ঘুমাতে হয়েছে। জানামতে, ঐ ছাত্রীটির আরেক কাছের বান্ধবী এতটা দূর পর্যন্ত ছুটোছুটি করতে পারেনি বলে শেষ পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। অথচ একাডেমিক রেজাল্ট অনুযায়ী সে তার তুলনায় ভালো ছিল।

প্রশ্ন হচ্ছে—এত বিস্তারিত বর্ণনায় যাচ্ছি কেন? কারণ ভুক্তভোগী না হলে দেশের কেউ বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। কর্তাব্যক্তিদের বেশিরভাগেরই বিশেষ সুবিধা রয়েছে। তারা পার পেয়ে যান। দেশে কিংবা বিদেশে তাদের ব্যবস্থা হয়ে যায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ পার পান না।

আরো কিছু বাস্তবতা হলো— একজন সন্তানের জন্য শিক্ষা ব্যয় বাবদ প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত যত টাকা ব্যয় হয় তার চেয়ে অধিক পরিমাণ টাকা লাগে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পেছনে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে কি না—এই অনিশ্চিয়তায় বাবা-মায়েরা নির্ঘুম কাটান দিনের পর দিন—তা তো বলাই বাহুল্য। উচ্চ শিক্ষার্থীদের জন্য এটাই সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে পরীক্ষার শিডিউল তৈরি করে। যাতে একজন শিক্ষার্থীর জন্য দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরম ক্রয় করতে অসুবিধা না হয়। প্রকারান্তরে বলা যায়, এই পদ্ধতির সুবিধা হলো—ফরম বিক্রিতে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে পড়ে না বরং একটা জাদুকরি ভারসাম্য বজায় থাকে।

২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি মেডিক্যাল কলেজগুলোর মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায় মানেই নির্দেশ। তাই রাষ্ট্রপতির নির্দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাযথ উদ্যোগ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সত্যি হলো—তার অভিপ্রায় বাস্তবায়িত হয়নি।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ বিষয়ে তার অসহায়ত্ব ব্যক্ত করে বলেছিলেন, বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এভাবে পরীক্ষা নিতে রাজি নয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা টাকা দিই ঠিকই কিন্তু তাদের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপাতে পারি না। তারা না-চাইলে আমরা তাদের ওপর জোর করতে পারি না। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।

বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি সর্বশেষ আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিরোধিতা করলেও শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের জন্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা খুবই জরুরি।

কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ইস্যুতে একমত হতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনে করছে, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হলে এসব প্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র্য থাকবে না। কোনো কোনো উপাচার্য বলছেন, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হলে তাদের নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরীক্ষিত নীতি—ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার কোনো উপাচার্য সহজ করেই বলছেন, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে আগ্রহী নন।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সরকার এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পরস্পর বিপরীতে অবস্থান করছে। ফলে কোনোভাবেই এর সুরাহা হচ্ছে না।

অনেকইে বলছেন, মেডিক্যাল কলেজগুলো যদি সমন্বিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে পারে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন পারবে না? শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কষ্ট দূর করার জন্যই এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার দরকার বলে আসছে সরকার। তার পরও কেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে রাজি হচ্ছে না?

পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষা থেকে ভর্তি ফরম বাবদ কোটি কোটি টাকা আয় করে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে তারা এই অর্থ উপার্জন করতে পারবে না। ফলে তারা এই লোকসান মানতে রাজি নয়। সে কারণেই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় তাদের অনীহা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমালোচিত হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফরম বিক্রি থেকে আয়কৃত টাকা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তারা নিজ নিজ ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার ব্যাপারটি মিঠে কথা মাত্র। আসল কথা হলো বাড়তি পয়সা উপার্জন। আর এই বাণিজ্যের নাম—ভর্তি-বাণিজ্য! চরম বিস্ময় এবং উদ্বেগের ব্যাপার এই যে, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলো হয়ে পড়েছে বাণিজ্যিক!

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কি তবে লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান? তা না হলে লোকসানের প্রসঙ্গ কেন আসে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সরকারি চাকুরে। নাগরিকদের করের টাকায় তাদের মাসিক বেতন হয়। কাজেই দেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। তারা নিশ্চয় শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কষ্ট লাঘব করতে সচেষ্ট হবেন।

বিরাজমান এই পরিস্থিতি সমাধানকল্পে দুটি বিষয় ভাবা যেতে পারে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে আশা করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজে থেকেই সরকারের কাছে সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তাব পেশ করবে।

প্রতিটি ভর্তি ফরমের মূল্য হবে নামমাত্র এবং অলাভজনক।

নিয়মিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি, পরীক্ষা চলাকালীন ডিউটি দেওয়া এবং খাতা দেখা বাবদ শিক্ষকরা যে হারে ভাতা পান ভর্তি পরীক্ষার বেলাতেও একই হারে ভাতা গ্রহণ করবেন। ছাত্র ভর্তি কার্যক্রম যেহেতু অপরিহার্য, তাই এ ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক ভিন্ন হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে শিক্ষার্থীবান্ধব, জ্ঞানের আধার। প্রদীপ যেমন আলো ছড়ায় তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় ছড়াবে জ্ঞানের আলো। নির্মল, কালিমাহীন ও প্রশ্নাতীত অবস্থান নিয়ে দীপ্যমান থাকবে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। ভর্তি-বাণিজ্য বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মূল আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে ভর্তি ফরম বাণিজ্যের মোহ কাটিয়ে উঠুক আমাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই এই কামনা করেন।

মহিউদ্দীন আহেমদ : সংস্কৃতিকর্মী।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049221515655518