পাবিপ্রবিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে মাসুদ বাহিনীর প্রধান

পাবিপ্রবি প্রতিনিধি |

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) গ্যালারী-২ এ যেন নেমে এসেছিলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের গেরিলাযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর-২ এর ক্র্যাক প্লাটুন ‘মাসুদ বাহিনীর’ প্রধান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আমেরিকা প্রবাসী কমান্ডার আবুল হাসান মাসুদ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা শহর বিশেষ করে তাঁর বাহিনীর যুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তখন পিনপতন নীরবতা, সবার শোনার আগ্রহ বাংলাদেশের গৌরবগাঁথা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের কথা। বিজয়ের মাসে এক মুক্তিযোদ্ধার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার আসরের আবহ ছিল অন্যরকম।

বুধবার বিকেলে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর-২ এর ক্র্যাক প্লাটুন মাসুদ বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা আমেরিকা প্রবাসী কমান্ডার আবুল হাসান মাসুদ। তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা শহরের গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর সব ভাইবোন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন

আবুল মাসুদ বলেন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর ঢাকা শহরের তরুণরা আমরা কিছু একটা করার জন্য ছটফট করতে থাকি। মুক্তিকামী তরুণ আমরা অস্থির হয়ে পড়ি দেশের জন্য কিছু করতে হবে। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো অস্ত্র নেই। তারপর বন্ধুরা মিলে আগড়তলা যাই এপ্রিলের শুরুতে। সেখানে মেলাঘর ক্যাম্পে যোগ দিয়ে তিন সপ্তাহের যুদ্ধকৌশল শিখে দেশে আসি। মুক্তিযুদ্ধের সুপার হিরো এ টি এম হায়দারের তত্ত্বাবধায়নে গড়ে ওঠা গেরিলাদের একজন আবুল হাসান মাসুদ হয়ে উঠি মাসুদ বাহিনীর প্রধান। পুরান ঢাকার বংশাল এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় সেই এলাকা আমার দায়িত্বে পড়ে। আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে বোমা বিস্ফারণ ঘটাই। মাসুদ বাহিনী ২৪ সেপ্টেম্বর হাবিব ব্যাংকের হাটখোলা শাখায় অপারেশন চালাই। সেখান থেকে সংগ্রহ করা টাকা মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক ফান্ডে পাঠানো হয়। সেই খবর বিশ্বের বড় বড় সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়। দলটি প্রকাশ্য দিবালোকে ব্যস্ততম মতিঝিল এলাকায় বোমা ফাটায়। আমার কাছে সরাসরি সহায়তা করে আমার বোন শামিমসহ সব ভাইবোন। 

মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অপারশেন করার আগে সহযোদ্ধা করিমকে নিয়ে গাড়ী ছিনতাইয়ের ঘটনা বলেন মাসুদ। সেই লোহমর্ষক কাহিনীর ঘটনা বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়। তার সহযোদ্ধা ছিলেন হাবিব, শহিদ, শামসু, আজাদ। স্মৃতিচারণের সময় মাসুদ নিজেও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। দেশ স্বাধীনের পর এলাকায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তার ওপর শৃঙ্খলা ফেরানোর দায়িত্ব বর্তায়। পুরান ঢাকার প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক মাসুদ।

আবুল হাসান মাসুদ বলেন, আমাদের যুদ্ধ ছিলো জনযুদ্ধ। গ্রামের মানুষ বিনা খরচে আমাদের থাকতে দিয়েছেন, খেতে দিয়েছেন। আশ্রয় দিয়েছেন। তাদের অবদান ভোলার নয়। গ্রামের মানুষের সহযোগিতা ছাড়া যুদ্ধ করা সম্ভব হতো না।

আবুল হাসান মাসুদের ছোট ভাই আবু মনজুর মোর্শেদ বলেন, ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের রাতের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ, বংশাল, শাখারী বাজার এলাকায় কেবল রক্ত আর রক্ত, ক্ষত বিক্ষত মৃত মানুষ, আর জ্বলন্ত মানুষকে আমি দেখেছি মাত্র ১৩ বছর বয়সে। সেই বয়সেই মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছে আমার পরিবারের সবাই। আমি নিজেও মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে কাজ করেছি। বড় ভাই মাসুদকে সহযোগিতা করেছি।

সভাপতির ভাষণে বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল হাসানের ছোট বোন বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন বলেন, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে দেশের ক্রান্তিকালে হাজারও তরুণের মতো মাসুদও মায়ের কাছে এসে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চায়। সকল মায়ের মতো আমার মাও তাঁকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেন। এই মহান মায়েদের জন্যই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিয়েছেন, দোয়া করেছেন বাংলার সহজ-সরল মায়েরা। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদান অপরিসীম। আজকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের ভ্যালুটাকে (মূল্য) আমাদের শিক্ষার্থীদের বহন করতে হবে, ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই বাংলাদেশ পেয়েছি।

প্রসঙ্গত, মাসুদ বাহিনীর ডান হাত হিসেবে কাজ করেছেন হাফিজা খাতুন। তিনি মাসুদ বাহিনীর  অন্যতম সদস্য হিসেবে গেরিলাযুদ্ধের পরিকল্পনা, যুদ্ধ পরিচালনা ও সমন্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি, তাঁর মা, অন্যান্য ভাইবোনেরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার, ওষুধ সরবরাহ, প্রাথমিক চিকিৎসা, বার্তা প্রেরণ, মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা এবং এক জায়াগ থেকে আরেক জায়গায় অস্ত্র বহনের কাজ করতেন। স্বাধীনতা পরবর্তী পুরান ঢাকার কোতয়ালি থানাসহ আশেপাশের এলাকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মেজর হায়দারের নির্দেশে কাজ করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু পরিষদের আহ্বায়ক ও ইতিহাস ও বংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হাবিবুল্লাহ সঞ্চালনা করেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051801204681396