রাজধানীর অভিজাত এলাকা ধানমন্ডির হাতিরপুলে নিজ ফ্ল্যাট থেকে ৮০ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হওয়া কারা অধিদফতরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) পার্থ গোপাল বণিক দুর্নীতিতে হাত পাকিয়েছেন অনেক আগেই। চাকরি জীবনের শুরু থেকে তিনি ঘুষ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার অবৈধ আয়ের প্রধান উৎসের মধ্যে ছিল কারাগারে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য, বন্দীদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অর্থ আদায়, কারাগারের উন্নয়নকাজের অর্থ আত্মসাৎ ও মাদক সিন্ডিকেট। মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আনিস রহমান।
স্বরাষ্ট্র (সুরক্ষা বিভাগ) মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দুদকের অভিযানে ৮০ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হওয়া সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি প্রিজন এর আগে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার পদে দায়িত্বে ছিলেন। তখনই পার্থ গোপাল বণিকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ওই সময় একটি গোয়েন্দা সংস্থা তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব আবদুস সোবহান শিকদার ও মহাপরিদর্শক (কারা) আশরাফুল ইসলাম খানের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পার্থ গোপাল বণিকের গ্রামের বাড়ি ঢাকার ধামরাইয়ে। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় স্থানীয় এমপি ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় পার্থ ডেপুটি জেলার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। তিনি টাঙ্গাইল, যশোর ও রাজশাহী কারাগারে জেল সুপার পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জুন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হিসেবে যোগদান করেন। তার পরিবার বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৫ আগস্ট, ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় শোক দিবসে যুদ্ধাপরাধী, শীর্ষ সন্ত্রাসী ও বিতর্কিত রাজনীতিবিদদের তাদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ অলিখিতভাবে বন্ধ রাখা হয়। ওই সময় জেল সুপার পার্থ গোপাল বণিক এসবের তোয়াক্কা না করে ১৫ আগস্ট স্বউদ্যেগে বিএনপির এমপি সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া রহমানের স্বামীকে তার অফিসকক্ষে একান্তে আলাপের ব্যবস্থা করে দেন। এরপর তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে বিশেষ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় তৎকালীন ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ অন্য ছাত্রদল, বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের অবৈধভাবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ নম্বর সেলে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লাসহ অনেক জঙ্গি বন্দী ছিলেন। জেল-কোড অনুযায়ী ওই সেলে যত্রতত্র যাতায়াত বা যোগাযোগের বিষয়ে সীমাবদ্ধতা থাকলেও তিনি তা উপেক্ষা করে সেখানে অবাধে যাতায়াত ও যোগাযোগ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি বাইরে পাচার করেছেন।
এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধী, বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রদল নেতাদের বিষয়ে আইজি ও ডিআইজি প্রিজনের সঙ্গে তার মোবাইলে যে কথোপকথন হয় তা তিনি রেকর্ড করে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের শুনিয়েছিলেন। সিনিয়র জেল সুপার পার্থ গোপাল বণিক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যোগদানের পরই কারাগারে কর্মরত হাবিলদার খলিলুর রহমান, কারারক্ষী রাহাত মিয়া ও রতন রায়ের মাধ্যমে কারারক্ষী ও কারাবন্দীদের বদলি এবং অন্যান্য কারাগারে স্থানান্তরের ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। আসামিদের খাবারসামগ্রী বাইরে বিক্রি, সেলের সিট বিক্রি, কয়েদি বন্দীদের কাজ পরিবর্তন এবং ভিআইপি বন্দীদের বিভিন্ন অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এ ছাড়া যশোর কারাগারে জেল সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এদিকে, গোয়েন্দা সংস্থার এই প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা-১ অধিশাখা ২০১২ সালের ১ এপ্রিল পার্থ গোপাল বণিকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে। মামলায় তার বিরুদ্ধে ২১টি অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পার্থ গোপাল বণিক যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে সিনিয়র তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় কারাগারের টাকায় বাদ্যযন্ত্র ও সাউন্ডবক্স ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় কিনে পরে তা মেরামতের নামে কারাগারের বাইরে পাঠিয়ে বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করা, কারাগারের বিভিন্ন এলাকায় লাগানো নানা প্রজাতির বড় বড় গাছ অবৈধভাবে কেটে তার কাঠ ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা, মুক্তি পাওয়ার পরও কয়েদি রামলালকে নিজের সরকারি বাসায় তিন সপ্তাহ আটকে রেখে ব্যক্তিগত কাজ করানো।
ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল কারাগারে : নিজের বাসা থেকে ৮০ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিককে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। গতকাল ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এ আদেশ দেন। আসামি পক্ষে আইনজীবী গাজী শাহ আলম, আসাদুজ্জামান খান রচি আদালতে পার্থ গোপালের জামিনের আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল জামিনের বিরোধিতা করেন।
এর আগে গতকাল ডিআইজি প্রিজনস পার্থ গোপাল বণিকের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলা করে কমিশন। মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষগ্রহণ ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার বাদী কমিশনের সহকারী পরিচালক মো. সালাউদ্দিন। দুদকের জনসংযোগ কার্যালয় মামলার বিষয়টি জানিয়েছেন। রবিবার ৮০ লাখ টাকাসহ ধানমন্ডির বাসা থেকে ডিআইজি পার্থকে গ্রেফতার করে দুদক। তাকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাকে নিয়ে ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা টাকা উদ্ধারে অভিযানে যায় দুদক টিম। তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক ডিআইজি। দুদকের তথ্য মতে, সরকারি চাকরিতে কর্মরত থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পার্থ গোপাল বণিক অবৈধ উপায়ে এবং বৈধ পারিশ্রমিকের অতিরিক্ত হিসেবে ঘুষ গ্রহণ করে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত ৮০ লাখ টাকা অর্জন করেছেন। এই টাকা তিনি নিজের দখলে নিয়ে পাচারের উদ্দেশ্যে নিজের বাসায় লুকিয়ে রাখেন।