পালিয়ে বেড়াচ্ছেন জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করা অধ্যক্ষ

নড়াইল প্রতিনিধি |

নড়াইলে ফেসবুকে ছাত্রের পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেন কলেজের ছাত্ররা ও স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা।

মহানবী (সা.)-কে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যকারী ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে ফেসবুকে নড়াইল সদরের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রের পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনায় লাঞ্ছিত হন তিনি।

অভিযুক্ত কলেজছাত্রের সঙ্গে আটক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ঘটনার সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় ওইদিনই থানা হাজত থেকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। ভয়ে ও আতঙ্কে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওই শিক্ষক ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তার পরিবার। 

এদিকে ৯ দিন ধরে পুলিশ পাহারায় অনেকটা গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন অধ্যক্ষের পরিবার। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কলেজ বন্ধ ও এলাকায় সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

এ ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্র রাহুল দেব রায়ের বিরুদ্ধে ডজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় তিনি কারাগারে আছেন। কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অব্যাহতি দিয়ে ওই কলেজের শিক্ষক আকতার হোসেন টিংকুকে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই ঘটনাটি ঘটলেও বিষয়টি খতিয়ে দেখতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জুবায়ের চৌধুরীকে। এ কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন জেলা শিক্ষা অফিসার ছায়েদুর রহমান ও সদর থানার ওসি শেখ শওকত কবীর।

পুলিশ প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন আহ্বায়ক, অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার রিয়াজুল ইসলাম, সদস্য ডিআইঅন মীর শরীফুল হক ও পুলিশ পরিদর্শক (অপরাধ) রফিকুল ইসলাম। তাদের ৩০ জুনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

পুলিশের উপস্থিতিতে অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনায় ক্ষোভ চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সম্মানিত অধ্যক্ষের অপমানে ক্ষুব্ধ হয়েছেন সারা দেশের শিক্ষকসমাজ ও সাধারণ মানুষ। এ ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। 

১৭ জুন নড়াইলে এ ঘটনার সূত্রপাত। ওইদিন মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় ওরফে বাপ্পী রায় নিজের ফেসবুক আইডিতে বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে পোস্ট করেন “প্রণাম নিও বস ‘নূপুর শর্মা’ জয় শ্রীরাম”।

বিষয়টি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে কলেজের ছাত্ররা তাকে সেটি মুছে ফেলতে বলেন। ১৮ জুন সকালে অভিযুক্ত ছাত্র কলেজে এলে তার সহপাঠীসহ সব মুসলিম ছাত্র তার গ্রেফতার, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও তাৎক্ষণিক বহিষ্কারের দাবি তুলে অধ্যক্ষের কাছে বিচার চায়।

ওই সময় ‘অধ্যক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক হওয়ায় তাকে রক্ষার চেষ্টায় ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন’ এমন কথা রটানো হলে উত্তেজনা তৈরি হয়।

এ সময় বিষয়টি কলেজের গণ্ডি ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধেও কঠোর প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থার দাবি জানান।

এ সময় অভিযুক্ত ছাত্র ও অধ্যক্ষের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে কলেজ ক্যাম্পাস। এ সময় খবর পেয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকটি দল ঘটনাস্থলে এসে বিক্ষুব্ধ জনতাকে লাঠিচার্জ করলে পরিস্থিতি আরও অশান্ত হয়ে ওঠে।

এরপর পুলিশের সঙ্গে উত্তেজিত জনতার তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে। দিনভর পুলিশ ও ছাত্র-জনতা দফায় দফায় সংঘর্ষে দুই পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। এ সময় মারাত্মক আহত হন কলেজের বাংলা বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কুমার ঘোষ।

ওই সময় বিক্ষুব্ধ জনতা কলেজের শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তাদের উপস্থিতিতে উত্তেজিত জনতা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রের পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিয়েছিল।

এ সময় গ্রেফতারের দাবি জানালে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস, অভিযুক্ত রাহুল দেব রায় ও তার বাবা বাবুল রায়কে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এসব ঘটনার কিছু ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে আসে। 

সরেজমিন সোমবার সদর উপজেলার বড়কুলা গ্রামে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ওই পরিবারের নিরাপত্তার জন্য রাতদিন ২৪ ঘণ্টা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

অধ্যক্ষের মা বনলতা বিশ্বাস বলেন, কলেজের ঘটনায় পুলিশ আমার ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার পর আর বাড়ি আসেনি। আমার সঙ্গে ফোনেও যোগাযোগ করেনি।

চাচাতো ভাই সুমিত্র কুমার বিশ্বাস বলেন, আমরা যতটুকু জেনেছি কলেজের ঘটনায় তাকে নিরাপত্তা দিয়ে থানা হেফাজতে রাখার পর ওই দিনই রিলিজ দেওয়া হয়েছে। তবে নিরাপত্তার অভাবে তিনি আর বাড়ি ফেরেননি।

পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় বলেন, তখন জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলার কাজে ব্যস্ত থাকায় অধ্যক্ষের গলায় কে বা কারা কখন মালা পরিয়েছে তা লক্ষ্য করিনি। তবে এ বিষয়ে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। 

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, কলেজ ভবন থেকে বের করে আনার সময় উত্তেজিত জনতার হাত থেকে অধ্যক্ষ ও শিক্ষার্থীকে বাঁচানোর জন্য পুলিশ হয়তো জুতার মালা পরানোর বিষয়টি লক্ষ্য করেনি। এসব ঘটনা তদন্তের জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

অধ্যক্ষ হেনস্থার প্রতিবাদে শাহবাগে সমাবেশ : ঢাবি প্রতিনিধি জানান, নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্থার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে সমাবেশ হয়েছে।

ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে তাকে হেনস্থা করা হয়। সোমবার বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে শাহবাগ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম।

এ দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে সমাবেশে মাইনরিটি রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (বাকবিশিস) নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

হেনস্থার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেতাদের নীরবতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন।

তিনি বলেন, নড়াইলে এ ঘটনায় যদি আমার ভেতরে বেদনা কাজ না করে তাহলে আমি শিক্ষক নই। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ শিক্ষক ফেডারেশন তাদের কাজটা আসলে কী?

এভাবে কি শিক্ষকরা একের পর এক অপমানিত হতেই থাকবে? শিক্ষক লাঞ্ছনা এখন শিক্ষক হত্যায় উপনীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবার কাছে আবেদন জানাই, শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং দেশকে রক্ষা করুন।

সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক আকরামুল হক।

যুব ইউনিয়নের সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুমের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শরীফুজ্জামান শরিফ, ঢাবির গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুর রাজ্জাক খান, শাহবাগের সংগঠক রবিন আহসান, বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক কাজল কুমার দাস, বাংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব রনজিত দেব, ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ফয়জুল্লাহ, যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হাবিব আদনান, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অমিদ রঞ্জন দে প্রমুখ।
 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066580772399902