পাল্টে গেছে শীতের ধরন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শীতের দাপুটে কাঁপছে রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চল। বইছে শৈত্যপ্রবাহ। প্রচণ্ড শীতে জবুথবু অবস্থা চারদেয়ালের ভেতরে বসবাসকারীদের। আরও শোচনীয় হয়ে পড়েছে দরিদ্র মানুষের অবস্থা। খানিকটা সময়ের জন্য দেখা মিললেও নিস্তেজ রোদে কমেনি তীব্র হিমশীতলতা। শুধু তাই নয়, গতকাল যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ছিল ছিল ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা দেশে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। 

শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার জন্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী, নিঃসন্দেহে। আবহাওয়াবিদরাও বলছেন তাই। তবে তারা এও বলছেন, আরও দুটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ। অন্যটি হচ্ছে ঘন কুয়াশার প্রলেপ। এ কারণে শীতের ব্যাকরণ পাল্টে গেছে। তাদের মতে, সাধারণত ঢাকায় এ সময়টাতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। কিন্তু গতকাল রবিবার ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অবশ্য কুয়াশা কেটে যাওয়ায় দুপুরে রোদের দেখাও মিলেছে, যদিও তাতে তেজ ছিল না।

আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রতিদিন দুবার ঢাকাসহ দেশের সব আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে আকাশে বেলুন উড়িয়ে স্বয়ংক্রিয় একটি যন্ত্রের মাধ্যমে তাপমাত্রা মেপে থাকে। সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে যত উঁচুতে ওঠা যায়, তাপমাত্রা তত কমতে থাকে। অবশ্য কোনো এলাকায় কুয়াশার স্তর যত ঘন হয়, সেখানকার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ততই কমে আসে। আর ভূপৃষ্ঠের ৫০০ মিটার ওপর থেকে প্রতি কিলোমিটারে তাপমাত্রা দুই-তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস করে কমতে থাকে। ঢাকার ওপরে চাদরের মতো প্রলেপ তৈরি করা কুয়াশার কারণে আবহাওয়ার চলতি ব্যাকরণে ব্যত্যয় ঘটেছে। ভূপৃষ্ঠের তুলনায় ওপরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। কুয়াশার ওপরের স্তরে রোদ থাকলেও ভূপৃষ্ঠে তা প্রবেশ করতে পারছে না। তাদের অভিমত, দেশে দিন-রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম থাকছে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম। এর কারণে সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে আসতে পারছে না। ফলে ভূপৃষ্ঠ এবং এর সংলগ্ন বাতাসের উষ্ণতা বাড়তে পারেনি।

ভারতের হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের তাপমাত্রা অনেক কম। শীত মৌসুমে সাধারণত ওই সব এলাকা (উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক) থেকে বাংলাদেশমুখী বাতাসের গতি থাকে। সেটাও শীতল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেঘমুক্ত আকাশ। সাধারণত আকাশ মেঘলা থাকলে বিকিরণ প্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠ শীতল হতে সময় লাগে। তাপমাত্রা ভূপৃষ্ঠে বেশিক্ষণ থাকতে পারে। ফলে ধরণি শীতল হতে না হতেই নতুন দিনে সূর্যের আগমন ঘটে। এতে মেঘমুক্ত আকাশ ধরণিকে দ্রুত শীতল করে। পাশাপাশি দীর্ঘ রাত সূর্যের আগমন বিলম্বিত করে। এসব কারণ উপস্থিত থাকায় ঊর্ধ্বাকাশের বাতাসের গতির জেট এক্সট্রিম (যেখানে তাপমাত্রা জিরো ডিগ্রি) নিচে নেমে এসেছে। এসব কারণ মিলিয়েই বাংলাদেশে শীতের প্রকোপ বেড়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেন, সাধারণত ভূপৃষ্ঠের ১২ হাজার থেকে ১৮ হাজার ফুট ওপর দিয়ে জেট উইন্ড বয়ে যায়; ঘণ্টায় ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে। এটি নিচে নেমে এসে প্রচণ্ড বাতাস সৃষ্টি করলে সেই বাতাসের ধাক্কায় জলীয় বাষ্প সরে যায়।

তিনি জানান, আগামী দুদিন শীতের এই অনুভূতি থাকতে পারে। দুদিনের মধ্যে কুয়াশা কাটতে শুরু করবে। ফলে রোদ বাড়বে; কমতে থাকবে শীত।

বাংলাদেশে এ বছর তীব্র শীত পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, জেট স্ট্রিম হলো ভূপৃষ্ঠের ৮ থেকে ১২ কিলোমিটার উচ্চতায় পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রায় যুদ্ধবিমানের গতিবেগে প্রবাহিত বায়ু। এই জেট তরঙ্গের শীর্ষ যে স্থানের ঊর্ধ্ব আকাশে অবস্থান করে তার পূর্বদিকে ভূমিতে বায়ুর উচ্চচাপ বিরাজ করে। এই সময় ঊর্ধ্ব আকাশ থেকে খুবই ঠা-া ও শুষ্ক বাতাস ভূমিতে নেমে আসে। যার কারণে ভূমিতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আবহাওয়া বিরাজ করে। এ রকম একটি জেট তরঙ্গ শীর্ষ ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখের পর থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারত ও উত্তর পাকিস্তানের ঊর্ধ্ব আকাশে অবস্থান করছিল। যার কারণে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ও জানুয়ারি মাসে গত ৭ দিনে উত্তর ও মধ্য ভারত এবং বাংলাদেশের ভূপৃষ্ঠে বায়ুর উচ্চচাপ অবস্থা বিরাজ করছে ও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এই দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিনিয়ত বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্ব আকাশ থেকে ঠাণ্ডা বাতাস ভূপৃষ্ঠে নেমে আসছে। ফলে তীব্র ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছে।

আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক এই গবেষক জানান, এবার শীত মৌসুমে একটু বেশি শীত থাকবে। জানুয়ারির মাঝামাঝি দেশব্যাপী হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। বৃষ্টির দুই থেকে তিন দিন পর ১৮ থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আবারও এক সপ্তাহের জন্য দেশব্যাপী কুয়াশা ও মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। ফেব্রুয়ারিতে দুই থেকে তিনটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে শীতকালে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও শীত বেশি অনুভূত হওয়ার প্রধান কারণ হলো জলাভূমি, খালবিল, নদীনালার পরিমাণ কমে কংক্রিটের অবকাঠামো বেড়ে যাওয়া। ঢাকায় আবহাওয়ার আচরণ হয়ে উঠছে সৌদি আরবের মরুভূমির মতো। মরুভূমি যেমন দিনের বেলা প্রচণ্ড গরম ও রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হয়- ঢাকায়ও তেমনটি হচ্ছে। কারণ, কংক্রিটের অবকাঠামো দিনের বেলায় দ্রুত সূর্যের তাপ শোষণ করে গরম হয়ে ওঠে এবং রাতে দ্রুত তাপ ছেড়ে দিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে।

গতকাল আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটাই এ পর্যন্ত চলতি শীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল সিলেটে, ২৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে গতকালও মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। এ ছাড়া রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ওপর দিয়েও শৈত্যপ্রবাহ বইছে। এ দুই বিভাগের ১৬ জেলাসহ দেশের ২৩টি জেলার ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বইছে।

অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজুলর রশীদ বলেন, দেশে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পার্থক্য কমে আসায় শীতের অনুভূতি বেশি ছিল। রোদ উঠলে এবং তা বেশি সময় স্থায়ী হলে দিনে তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। তবে রাতে কিন্তু বেশি শীতই থাকবে। আগামী দুই থেকে তিন দিন দেশের উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ থাকবে, জানান তিনি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও - dainik shiksha ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল - dainik shiksha বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক - dainik shiksha এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025928020477295