পুরোনো আইনে তনু হত্যার সুষ্ঠু বিচার সম্ভব নয়: প্রধান বিচারপতি

নিজস্ব প্রতিবেদক |

বাংলাদেশের অনেক আইন সেকেলে হয়ে গেছে। পুরোনো ফৌজদারি আইন ও সেকেলে মানসিকতা দিয়ে তনু হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার সম্ভব নয়। নতুন ডিজিটালাইজড পন্থায় এ অপরাধের তদন্ত করতে হবে। যতই মিছিল করা হোক না কেন, পুরোনো আইন দিয়ে তা সম্ভব নয়। এ কথা বলেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

গতকাল শনিবার আইন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক এম শাহ আলমের লেখা দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রধান বিচারপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে বাংলাদেশে আইনের সংস্কার ও আইন কমিশন এবং সিলেক্টেড রাইটিংস অন ইন্টারন্যাশনাল ল, কনস্টিটিউশনাল ল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার তদন্ত প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে প্রচলিত বিচারব্যবস্থার মিল নেই। এ জন্য বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রযুক্তি ও দুর্নীতি এমনভাবে বেড়ে গেছে, সেকেলে আইন ও মানসিকতা দিয়ে এগুলোর বিচার করা সম্ভব নয়। নতুন ডিজিটালাইজড পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেকেলে পদ্ধতির জন্য এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার করা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশে এখনো ১৮৩৬, ১৮৭২, ১৮৯৮ সালের সেকেলে আইন রয়েছে উল্লেখ করে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, প্রয়োগ করতে গেলে দেখা যায় এসব আইনের ব্যবহারিক কার্যকারিতা খুব কম। তিনি বলেন, ‘আমাকে একটা বিষয় পীড়া দেয়, যখন দেখি নতুন যেসব আইন বা সংবিধান সংশোধন হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে আইনসভায় আলোচনা হয় না। আইনের উদ্দেশ্য বোঝার জন্য যখন সংসদীয় বিতর্ক নিয়ে আসি, এতে কিছু পাই না।’

আইনপ্রণেতাদের অন্যতম দুর্বলতা হলো আইন বিষয়ে অজ্ঞতা—এ কথা উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘অজ্ঞতা থাকতে পারে, আমারও অজ্ঞতা আছে। কিন্তু এমপিদের মধ্যে লেখাপড়া করা, আইন বোঝার একাগ্রতা কম দেখা যায়। এ জন্য ধীরে ধীরে আইনসভায় আইনের চর্চা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।’

বক্তব্যের এ পর্যায়ে আইন প্রণয়নের ধাপগুলো কেমন হওয়া উচিত, তা ব্যাখ্যা করেন প্রধান বিচারপতি। বলেন, প্রথমে আইন কমিশন একটি আইন নিয়ে চিন্তাভাবনা ও আলোচনা করবে, এরপর সে বিষয়ে অংশীদারদের কাছ থেকে মতামত নেবে। তারপর তারা প্রতিবেদন দেবে, এর ওপর সংসদে বিতর্ক হবে, খসড়া তৈরি হবে, তারপর সেটা আইন হবে। কিন্তু বর্তমানে এগুলো হচ্ছে না।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এখন নানা ধরনের সার্কুলার, এসআরও, পরিপত্র—এসব দিয়ে বিচার চলছে। এগুলো নিয়ে আমরা যেমন খেই হারিয়ে ফেলি, তেমনি বেশ কিছু বৈষম্য থেকে যায়। আমরা হিমশিম খেয়ে যাই।…আইন ত্রুটিপূর্ণ থেকে গেলে জনগণ ভোগান্তিতে পড়ে, বিচার বিভাগে চাপ পড়ে।’

আইনজীবীদের বাণিজ্যিক মানসিকতা পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, আইনজীবীদের মধ্যে প্রবণতা থাকে যাতে দ্রুত জামিন, নিষেধাজ্ঞা বা স্থগিতাদেশ নিয়ে টাকাপয়সা কামানো যায়। মামলাজট কমানোর জন্য পুরো বিচারব্যবস্থার সংস্কারের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, বর্তমান অবস্থায় কেউ সঙ্গে সঙ্গে বিচার পাচ্ছে না। দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মে গিয়ে বিচার পাচ্ছে। এটা একধরনের তামাশা।

নির্বাহী বিভাগ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, প্রশাসন কখনো চায় না, বিচার বিভাগ ঠিকমতো কাজ করুক। এটা সারা দুনিয়ায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সব দেশে এটা হচ্ছে। তিনি বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারকাজ পরস্পরবিরোধী বিচারব্যবস্থা। এক দেশে দুই বিচারব্যবস্থা কেন চলবে?

বিচার বিভাগ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। এ আশ্রয় ধ্বংস না করার আহ্বান জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, একজন রাজনীতিককে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা যায়, সরকারি কর্মকর্তাকে সরানো যায়। কিন্তু বিচারব্যবস্থার ওপর যদি মানুষের আস্থা হারিয়ে যায়, তাহলে তার যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না। বিচারব্যবস্থা না মানলে দেশ ও সংবিধান থাকে না।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উন্মুক্ত আলোচনার এক পর্যায়ে জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, ‘এখানে প্রধান বিচারপতি আছেন, তাঁর সামনেই বলতে চাই, দেশের নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত রায় বেচাকেনা হয়।’

অধ্যাপক বারকাতের এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি সগর্বে ঘোষণা করছি, আমার বিচার বিভাগে কোনো রায় বেচাকেনা হয় না। ৫ থেকে ১০ শতাংশ এদিক-সেদিক হতে পারে। ঢাকার সিএমএম (মুখ্য মহানগর হাকিম) নিয়োগ দিতে আমার ছয় মাস লেগেছে, সিজেএম (মুখ্য বিচারিক হাকিম) নিয়োগে তিন মাস লেগেছে। আমি চেষ্টা করেছি, যদি একজন জেলা জজ সৎ মানুষ হয়, তবে সেই জেলায় যেকোনো অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ জায়গায় আমি কমপ্রোমাইজ করিনি।’

অধ্যাপক বারকাতের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘আপনি যখন একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে সবগুলো ঋণ ঠিকমতো দিয়েছেন? কমপ্রোমাইজ করতে হয়েছে। উপায় নেই, বাধ্য হয়েছেন।’

এ সময় আবুল বারকাত মাথা নাড়িয়ে এ বক্তব্যের সঙ্গে অসম্মতি জানালে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘একটাতে বাধ্য হয়েছেন, আমি জানি। এই দেশে যেখানে অনিয়ম রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সেখানে বিচার বিভাগ তো কোনো আলাদা দ্বীপের না। এই দেশের বিচারকেরা তো আপনার-আমার ছেলেমেয়ে। আইনজীবীরা এই সমাজের সবার সঙ্গে মিশে আছেন। সব জায়গায় অনিয়ম চলবে আর বিচার বিভাগের সব ফেরেশতা হয়ে যাবে, এটা কোনোভাবেই আশা করা যায় না।’ বিচার বিভাগকে ইচ্ছামতো সমালোচনা না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যে সিস্টেম আছে, এটাকে মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।’

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিকেরা আমলাদের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। আমলাতন্ত্রের এই চরিত্র পরিবর্তন করা না গেলে পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিচার বিভাগকে আরও জনবান্ধব, গণবান্ধব করার জন্য প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে আমরা আরও বেশি করে নির্দেশনা আশা করি।’

চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতার প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান বলেন, কেন নির্বাচনী সহিংসতা হবে? কেন ৩২ জন মানুষ মারা যাবেন? কেন নির্বাচন কমিশন তার নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করছে না? যদি কোনো কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন যে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় না রেখে কাজ করা যায় না, তাহলে কপালকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন আবদুল্লাহ আল ফারুক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন সরকার আলী আক্কাস প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক রহমতউল্লাহ্।

অনুষ্ঠানের এসব বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, আইন প্রণয়ন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। খসড়া থেকে শুরু করে সংসদে উপস্থাপন করা পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ পার হয়ে যেতে হয়। সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়, সেখানে বিশেষজ্ঞরা থাকেন। হঠাৎ কোনো আইন সংসদে উপস্থাপন করা হয় না। অন্য কোনো বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে চাননি।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এসব বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002810001373291