পুলিশের স্থাপনায় হামলা কেনো

বিপ্লব বড়ুয়া |

তিন অক্ষরের একটি নাম ‘পুলিশ’। এই নামটি নিয়ে বিগত ক’দিনে দেশে প্রচণ্ড রাগ ক্ষোভ বয়ে গেছে। যা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক পুলিশ সদস্য জীবন দিয়েছেন; আহত হয়েছেন, যা ছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে পুলিশের ওপর এমন বর্বরোচিত হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ সাধারণ শ্রেণি-পেশার মানুষকে হতবাক, বিস্মিত, বিচলিত করেছে। পুলিশ শব্দটি শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর সবদেশে বিরাজমান। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রতিটি দেশেই পুলিশের রয়েছে অনন্য ভূমিকা। কিন্তু আমাদের দেশে কেনো পুলিশের ওপর এ রকম বর্বর ন্যক্কারজনক হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা হলো? তাদের অপরাধ কী ছিলো? এ কেমন দেশ, এ কেমন পরিবেশ, ভাবতে গা শিউরে ওঠে। আমরা কোন অন্ধকার যুগে বাস করছি; দেশজুড়ে এ নিয়ে চলছে ব্যাপক বিশ্লেষণ। বিষয়টি শুধু আশ্চর্যের নয়; অতি-আশ্চর্য হয়ে বাংলাদেশের চোখে ধরা পড়েছে। এ রকম জঘন্য নৃশংস বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে দেশের মানুষ লজ্জিত, ঘৃণিত, বিস্মিত।

বাংলাদেশের জনগণ পুলিশবিহীন পাড় করেছে ৫টি দিন। বছরের কোনো একটি দিন বা ১ মিনিট সময়ের জন্যও যেখানে দেশের পুলিশস্থাপনার আলো নিভে না; সেখানে বিগত ৫ আগস্ট দুপুরের পর থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত দেশের প্রায় সাড়ে চারশতাধিক থানা ও স্থাপনাগুলোতে আলো জ্বলেনি। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের অফিসগুলোর অবস্থাও একই চিত্র। সবখানে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা, ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিরাজ করছে হাহাকার শূন্যতা। দেশের সব থানা ও স্থাপনাগুলোতে আলো জ্বলতে আর কতোদিন লাগতে পারে তারও কোনো সঠিক তথ্য নেই। তবে পুলিশ প্রধান তার এক বক্তব্যে গত ৮ আগস্ট নির্দেশ জারি করেছে সব পুলিশকে সন্ধ্যার মধ্যে নিকটস্থ জেলা পুলিশ লাইনে যোগদান করতে। ছাত্র-জনতার নামে কিছু উশৃঙ্খল দুস্কৃতকারীরা পুলিশ ও তাদের স্থাপনায় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে; এ রকম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাহীনতায় পুলিশরা তাদের কর্মস্থলে যোগ দেয়া থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখেন। প্রতিটি দেশের আইনশৃঙ্খলায় প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন পুলিশ বাহিনী। রাতদিন রোদ, ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে অপরিসীম ত্যাগ ও পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে পুলিশরা কাজ করে থাকেন; যা অন্যকোনো বাহিনীর ক্ষেত্রে তেমন একটা চোখে পড়ে না। বাংলাদেশে এইবারই প্রথম এবং বিশ্বের আর কোনো দেশে থানা আক্রমণ করে কর্মরত পুলিশদের হত্যা, অস্ত্রশস্ত্র লুটপাট, দলিল-দস্তাবেজ, আসবাবপত্রসহ ভবন পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা সম্ভবত এটিই প্রথম। এই কদিন পুলিশদেরকে এক বিভীষিকাময় সময় পার করতে হয়েছে; যা ছিলো অবিশ্বাস্য। পুলিশরা পানি, ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে পারলেও আর কিছু পুলিশকে উগ্রবাদী উশৃঙ্খল জনগোষ্ঠীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। তাদেরকে মাথা, মুখে, শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করতে করতে মেরে ফেলেছে। একটি মুক্ত স্বাধীন দেশে এমনটি কেউ আশা করেনি। গত ৫ আগস্ট দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ডাকা টানা কর্মসূচির একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ব্যাপক হামলা চলে। সেই থেকে পুলিশ স্থাপনায় আলোর বদলে ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। জনগণের নিরাপত্তার প্রধান আশ্রয়স্থল থানা, পুলিশের ওপর এমন হামলা ও হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তারা মানুষ নামের এক শ্রেণির মানুষরূপী দানব! আধুনিক এই সভ্য সমাজে এ রকম কর্মকাণ্ড কী কখনো ভাবা যায়!  

পুলিশের অনুপস্থিতিতে এই কদিনে দেশব্যাপী অসংখ্য অপরাধমুলক ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলো ভয়াবহ ডাকাতের কবলে পড়ে। লুটপাট চলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসা বাড়িতে। হামলার শিকার হয় সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি। হামলা ও হত্যাকাণ্ড থেকে বাদ যায়নি সদ্য সরকার থেকে পদত্যাগী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের শত শত কার্যালয়, নেতা-কর্মী ও তাদের বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা হত্যা, হামলা, লুটপাটে ছাত্র আন্দোলনের কেউ জড়িত নয় বলে গণমাধ্যমকে জানান। আন্দোলনের সন্বয়ক ছাত্রনেতারা এই জাতীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতাকে প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছন। পুলিশের এই নড়বড়ে অবস্থা হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর দায় কোনো অংশে কম নয়।

স্বাধীনতার পর যে দল বা শাসকগোষ্ঠী দেশ চালিয়েছে তারা প্রত্যেকেই পুলিশকে নিজেদের বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। পুলিশ হচ্ছে জনগণের বন্ধু এই চিরাচরিত বাণীটি পৃথিবীর সব দেশে প্রতীয়মান, শুধু আমাদের দেশে পুলিশকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করায় প্রত্যেক শাসকগোষ্ঠী। সাধারণ জনগণের কাছে পুলিশ হয়ে ওঠে এক ভয়ংকর এক আতঙ্কের নাম। জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা থেকেও সরকার পার্টিসংশ্লিষ্ট নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত হতে থাকে পুলিশ। সেই সুযোগকে অপব্যবহারে কাজে লাগায় সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরা। থানা পরিণত হয় চাঁদা তোলার ক্লাব ঘরে। আজ দেশব্যাপী পুলিশ বাহিনীর এই হাল হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোই একমাত্র দায়ী। আবার পুলিশ বাহিনীর কিছু কিছু উচ্চাভিলাষী অফিসারদেরও রয়েছে ব্যাপক গাফিলতি। তারা নিজেদের স্বার্থে নিম্নস্তরের পুলিশদের ব্যবহার করেছে যত্রতত্রভাবে। কিছু পুলিশ ফুটপাতের দোকানদার থেকে শুরু করে গাড়ির ড্রাইভারদের পকেট কাটে। থানায় আইনের আশ্রয় নিতে গিয়ে মানুষকে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। যে বাহিনীকে সুদক্ষ করে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সৎ সততা, শৃঙ্খলা ও ন্যায়ের যে প্রতিজ্ঞা পাঠ করানো হয়, চাকরিতে প্রবেশের কয়েকদিনের মাথায় তা বেমালুম ভুলে যায়। অবশ্য পুলিশ বাহিনীর সবাইকে দোষী করা ঠিক নয়; এর মধ্যে সৎ ন্যায়-নিষ্ঠবান পুলিশকেও আমরা দেখতে পাই। পুলিশের নানাবিধ কর্মকাণ্ডে বন্ধু থেকে আতঙ্কে পরিণত হওয়ার কারণে রাগ ক্ষোভে আজ গণবিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটেছে বলে অনেক মনে করেন। এখন খোদ পুলিশ বাহিনীতে কর্মরতরাই সংস্কারের আওয়াজ তুলেছে। তারা চাকরি করতে হলে কয়েকটি শর্তও পুরণের দাবিও তুলে ধরেছেন।

নন-বিসিএস অধস্তন পুলিশে কর্মরতরা যেসব দাবি বা শর্ত পুরণের জন্য জোটবদ্ধ হয়েছে সেগুলো হলো-পুলিশ বাহিনীর প্রচলিত পুলিশ আইন এবং পুলিশ রেগুলেশন্স অব বেঙ্গল অ্যাক্ট সংস্কার করে যুগোপযোগী এবং কার্যকর করা। সাব ইন্সপেক্টর/সার্জেন্ট পদে বিদ্যমান পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা। পুলিশ পরিদর্শক পদ থেকে সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে ৩০ শতাংশ সরাসরি এবং ৭০ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা। পুলিশ হত্যাসহ সব স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওয়াতায় আনা। নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারকে এককালীন আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান, আজীবন পেনশন রেশন প্রাপ্তি এবং পরিবারের একজন সদস্যের সরকারি চাকরি ও আহত পুলিশ সদস্যদের আর্থিক ক্ষতিপুরণ নিশ্চিত করা। আমি মনে করি তাদের কথাগুলো আমলে নেয়া জরুরি, এই শর্তগুলো পুরণ হলে একটি সয়ংসম্পূর্ণ বাহিনী হিসেবে নিজেদেরকে আবির্ভূত করতে আর কোনো বাধা থাকবে না। পুলিশ বাহিনীকে ভবিষ্যতে আর কোনো রাজনৈতিক দল যেনো তাদের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করতে না পারে সে ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলকে সজাগ দৃষ্টিতে পরিচালনা করতে হবে।   

পুলিশের ওপর বেপরোয়া হামলায় দেশের আইনশৃঙ্খলা নিষ্ক্রিয় হয়ে পরা এবং একই সঙ্গে দীর্ঘসময় থানাগুলো অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে থাকায় বর্হিবিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। দেশের ধর্মান্ধ উগ্র জনগণের কারণে দেশ সম্পর্কে ইতোমধ্যে নেতিবাচক মনোভাব পরিণত হয়েছে; যা দেশের জন্যও চরম ক্ষতিকর। পুলিশের ওপর যদি অনাস্থা প্রকাশ পায়, দেশ চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আইনশৃঙ্খলার অবনতির সংবাদে বিদেশি বিনিয়োগ সংকুচিত হবে, দেশের জনগণ চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত হবে, দেশ হবে দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র। অতএব দেশের স্বার্থে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুলিশ বাহিনীকে আধুনিকতার সঙ্গে গড়ে তোলার সমস্ত রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে দেশ আবার ঘুরে দাঁড়াবে, সমৃদ্ধি ও উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে। পুলিশের ভাবমূর্তি পুনরায় ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের মনোবল চাঙ্গা করতে মোটিভেশনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। আর না হলে যতোই পুলিশ কাজে যোগদান করুক না কেনো তাদের মনের মধ্যে থেকে ভয়ভীতি আতঙ্কের ছাপ ঘুচবেনা।  

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা - dainik shiksha পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম - dainik shiksha ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় - dainik shiksha এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো - dainik shiksha প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030348300933838