পৃথিবী হোক ক্ষুধামুক্ত

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জিং। বহু বছর ধরেই একটা ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার চেষ্টা করা হলেও বিশ্ব নেতৃত্ব আজো সফল হয়নি। বরং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব রয়েছে। কোথাও কোথাও যে দুর্ভিক্ষ নেই, তাও অস্বীকার করা যাবে না। একটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিটি দেশেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত। 

ষাটের দশকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কিংবা আমদানির মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য সরবরাহ বা প্রাপ্যতার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হতো। পরবর্তীতে অনেক দেশ কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করে খাদ্য নিরাপত্তাকে টেকসই পথে নিয়ে যায়। ক্ষুধার চাহিদা পূরণে পৃথিবীজুড়েই বিপরীত চিত্র। কোথাও অতিরিক্ত খাদ্য নষ্ট হচ্ছে আবার কোথাও ক্ষুধার জন্য শিশু আর্তনাদ করছে।  

করোনা পরিস্থিতিতে ক্ষুধার যন্ত্রণা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছিলো। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে 'করোনা'র তাণ্ডব শুরু হলেও এখনও পুরোটা শেষ হয়নি। বিশ্বের ২৭টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, কোভিড -১৯ এর একটি সংক্রামক রূপ ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। এই নতুন ধরনটিতে ওমিক্রন সাব-ভেরিয়েন্টের কেএস ১.১ এবং কেপি. ৩.৩ এর মিশ্রণ রয়েছে। কেএস ১.১ এফএলআইআরটি ভ্যারিয়েন্ট; যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোভিডকে ছড়ানোর কাজ করছে। অন্যদিকে কেপি ৩.৩ এফএলইউকিউই ভ্যারিয়েন্ট; যার মধ্যে মানুষের শরীরে অতি দ্রুত এই ভাইরাস মিশে যাওয়ার ক্ষমতা আছে।

বিদ্যমান করোনা মানুষের জীবনকে দুঃসহ করে তুলেছে। এর সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহ, সংঘাত প্রভৃতি মিলে খাদ্য নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। করোনায় পৃথিবীতে বহু ধরণের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি যা করোনার শুরু থেকেই একটি ধারণা দেওয়া হয়েছিল। সেজন্য বিভিন্ন দেশে টেকসই খাদ্যনীতি গ্রহণ করা জরুরি। স্বনির্ভরতার কোনো বিকল্প নেই।

উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত বৃদ্ধি করা এবং ভোক্তার হাতে তা সহজলভ্য করা জরুরি। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে 'দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষ' (পোভার্টি অ্যান্ড ফেমিনস) নামে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেন। ওই নিবন্ধে তিনি বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির কারণগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেন। সাধারণত দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে খাদ্যের অভাবকে বা অপ্রতুলতাকে দায়ী করা হয়। 

অমর্ত্য সেনের মতে, মূল বিষয়টি আসলে সেরকম নয়। খাদ্য বণ্টনে বৈষম্য ও অসমতা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেলে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ওই নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন যে, সমাজের প্রতিটি মানুষের ‘Entitlement’ তথা কোনো দ্রব্যসামগ্রী অর্জনের সক্ষমতা রয়েছে। একজন ব্যক্তির Entitlement বেশকিছু কারণে (যোগানের ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম বাস্তবায়ন, ফসলে কীটপতঙ্গের বিস্তার বা যুদ্ধের কারণে খাদ্য বণ্টনে ব্যাঘাত) পরিবর্তন হতে পারে।

দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যাভাব বলতে কেবল খাদ্য পর্যাপ্ত না থাকালেই হবে এমন নয় বরং ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে না যাওয়া বা পূরণ করতে না পারাতেও তৈরি হতে পারে। যেমনটা অনেক যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে ঘটেছে। 

একটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো খাদ্য নিরাপত্তা। এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছানো সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকতে হবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এখন লড়াই করছে খাদ্য সংকট মোকাবিলায়। তবে করোনা সেই লড়াইয়ে  বাধার সৃষ্টি করছে এবং যে সাফল্যে পৃথিবী অগ্রসর হচ্ছিল সেখানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।

গত বছর প্রকাশিত এক তথ্যে পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বা খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে তার আভাস পাওয়া গেছে। অর্থাৎ পৃথিবীকে একটি দীর্ঘ সময় ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। চলতি বছর মে মাসে প্রকাশিত বৈশ্বিক খাদ্য সংকট প্রতিবেদন ২০২৪-এ দেখা যায়, বিশ্বে গত এক বছরে নতুন করে খাদ্য সংকটে পরেছে আরও দুই কোটি মানুষ। করোনার কারণে অর্থনৈতিক সংকট, বৈরী আবহাওয়া, যুদ্ধ সংঘাতে বিধ্বস্ত মানুষগুলো নিয়মিত খাবার পাচ্ছে না। এ ধরনের খাদ্য সংকটে গত বছর পরেছিল ১৩ কোটি মানুষ। এক শ্রেণির মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য পাচ্ছে এবং এর একটা অংশ নষ্ট হচ্ছে; বিপরীতে অন্য শ্রেণি দুবেলা দুমুঠো খাবারের নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। 

এক যুগ ধরে এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করে আসছে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর জোট ‘গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অ্যাগেইনস্ট ফুড ক্রাইসিস’। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বুরকিনা ফাসো, দক্ষিণ সুদান ও ইয়েমেনের ১ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ খাদ্য সংকটের কারণে মৃত্যুর মুখে আছে। এছাড়া অন্য দেশগুলো হলো—সিরিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, হন্ডুরাস, মোজাম্বিক, সিয়েরা লিওন, উগান্ডা ও ক্যামেরুন। কেবল করোনা অতিমারিরর কারণেই নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলা যুদ্ধ বা হানাহানির কারণেও সেখানকার মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছে।

একটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা তৈরি করতে হলে বাজারে উৎপাদিত পণ্যের সহজলভ্যতা এবং সুপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় ধরে করোনা মহামারির তান্ডবে বিশ্বের অনেক স্থানে জিডিপি কমে যাওয়া, শিল্প-কারখানা বন্ধ, উৎপাদন কমে যাওয়া, কর্মসংস্হান হারিয়ে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি , আয় কমে যাওয়া, ব্যবসায় বাণিজ্যে স্থবিরতাভাব, মুদ্রাস্ফীতি (অত্যধিক অর্থ অতি সামন্য সংখ্যক দ্রব্যসামগ্রীর পিছনে ধাওয়া করা) বৃদ্ধিজনিত কারণে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। এ মন্দা যেন ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের সেই মহামন্দাকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় তছনছ করে দিয়েছে অনেক অঞ্চলের খাদ্য ব্যবস্থাকেও।

পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণ শুরুর আগেই বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৬৯ কোটি বা ৬৯০ মিলিয়ন। শতকরা হিসেবে যা বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ৯ ভাগ। করোনাকালে খাদ্য সরবরাহ এবং বাজার স্থিতিশীল থাকলেও অর্থনৈতিক স্থবিরতায় বেকারত্ব এবং আয় হারিয়ে এই সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে। বিদ্যমান এই বিশাল ক্ষুধার্ত মানুষের সঙ্গে গত এক বছরে যোগ হয়েছে আরও প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি ক্ষুধার্তমুখ। আর একই সময়ে চরম অপুষ্টির শিকার হয়েছে ৫ বছরের কম বয়সী অন্তত আরো ৯০ লাখ শিশু।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের তুলনায় এ বছর বিশ্বে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতিতে পড়া মানুষের সংখ্যা ছয় গুণ বেড়েছে। ‘দ্য হাঙ্গার ভাইরাস মাল্টিপ্লাইস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, বিশ্বে মহামারি করোনায় যেখানে মিনিটে ৭ জনের মৃত্যু হচ্ছে সেখানে ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে ১১ জন। গত বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অক্সফাম সতর্ক করে বলেছিল, করোনার প্রাদুর্ভাব বিশ্বের ক্ষুধা সংকটকে আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী মহামারির বছরে বিশ্বে ক্ষুধা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে আফ্রিকায়। জাতিসংঘ বলছে, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে বৈশ্বিক ক্ষুধা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। মহামারির প্রভাব পুরোপুরি খতিয়ে দেখা না হলেও কয়েকটি সংস্থার এক যৌথ প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগ বা ৮১ কোটি ১০ লাখ মানুষ গত বছর অপুষ্টিতে ভুগছে। বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির অবস্থা শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দ্বিতীয় লক্ষ্য (২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করা) পূরণ হবে না এবং প্রায় ৬৬ কোটি মানুষ ক্ষুধার্তই থেকে যাবে। এই ৬৬ কোটির মধ্যে প্রায় ৩ কোটি মহামারির দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে।

বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করতে চাইলে পৃথিবীতে আসন্ন বিপজ্জনক জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে হবে। ফসল উৎপাদনে প্রতি ইঞ্চি মাটির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পৃথিবী হোক ক্ষুধামুক্ত সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।।

লেখক : সাংবাদিক।
[email protected]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রথম শ্রেণির ভর্তিতে কেন লটারি - dainik shiksha প্রথম শ্রেণির ভর্তিতে কেন লটারি এসএসসি ২০২৫-এর ফরম পূরণ ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫-এর ফরম পূরণ ১ ডিসেম্বর কওমি ও আলিয়া মাদরাসার প্রাচীর উঠিয়ে দিতে হবে - dainik shiksha কওমি ও আলিয়া মাদরাসার প্রাচীর উঠিয়ে দিতে হবে শাবাশ অন্তর্বর্তী সরকারের দক্ষতা ও দেশপ্রেম - dainik shiksha শাবাশ অন্তর্বর্তী সরকারের দক্ষতা ও দেশপ্রেম এইচএসসির ফল তৈরিতে নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এইচএসসির ফল তৈরিতে নতুন নির্দেশনা অধ্যক্ষ মাহবুব মোল্লাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট - dainik shiksha অধ্যক্ষ মাহবুব মোল্লাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট এসএসসি ২০২৫ -এর টেস্টের ফল ২৭ নভেম্বরের মধ্যে - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ -এর টেস্টের ফল ২৭ নভেম্বরের মধ্যে এসএসসির নম্বরের ভিত্তিতে হবে বাতিল এইচএসসির ফল - dainik shiksha এসএসসির নম্বরের ভিত্তিতে হবে বাতিল এইচএসসির ফল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0057899951934814