পেনশনের টাকায় ২৫ বছর ধরে অনাথ আশ্রম চালাচ্ছেন দুলাল

দৈনিক শিক্ষাডটকম, নীলফামারী |

কারো বাবা নেই, কারো নেই মা। আবার কারো বাবা-মা কেউই নেই। এসব অনাথ মেয়েদের মাথা গোজার ঠাঁই ‘চাঁদমনি’ বালিকা কল্যাণ কেন্দ্র। অনাথ মেয়েদের জন্য ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে নীলফামারীর জলঢাকার বালাগ্রাম ইউনিয়নের চাওড়াডাঙ্গী গ্রামে ১ একর ১০ শতাংশ জমির ওপর এই আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা পিজিরুল আলম দুলাল।  

পেনশনের টাকায় ২৫ বছর ধরে মেয়ে শিশুদের লালন-পালন করছেন তিনি। আশ্রমটিতে এতিম, অনাথ ও দরিদ্র মেয়েদের থাকা খাওয়া ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া ধর্মীয় শিক্ষা ও খেলাধুলাসহ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সহায়তায় অনেকে পাচ্ছেন উচ্চশিক্ষার সুযোগ। নিঃসন্তান এই অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা এখন শত শত অনাথ কন্যার অভিভাবক। মা-বাবার আদর দিয়ে এসব শিশুকে আগলে রেখেছেন তিনি। শতাধিক শিশুকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

  

পিজিরুল আলম দুলাল ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে উত্তরা ব্যাংকের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। এরপর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে চলে আসেন। নিঃসন্তান হওয়ায় সমাজের অবহেলিত ও অনাথ শিশুদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন ছিল তার। সেই অনুযায়ী পাঁচ অনাথ শিশুকে নিয়ে পৈতৃক সম্পত্তিতে ‘চাঁদমনি’ নামে অনাথ আশ্রম গড়ে তোলেন। কন্যাদের লালন করতে গিয়ে শেষ করেছেন নিজের পেনশনের টাকা। তবে তাতে তার কোনো আফসোস নেই।

প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত এই আশ্রমটিতে বর্তমানে বসবাস করছে ৩০ অনাথ মেয়ে। তারা এখান থেকে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। পাশাপাশি সকাল-সন্ধ্যা দু’বেলা তাদের পড়াশোনা করান দুলাল নিজেই। একই সঙ্গে যেসব শিশুর বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়স হয়নি তাদেরও হাতেখড়ি দেন তিনি।

গত ২৫ বছরে আট শতাধিক মেয়ে লেখাপড়া শিখে বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করছেন। জেলার সবার কাছে চাঁদমনি আশ্রম পরিচিত। এখানে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়া শেখানো হয়। যাদের বাবা নেই, মা নেই অথবা বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই এমন শিশুদের শিক্ষিত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাই তার মূল উদ্দেশ্য। এখানে মেয়েদের সপ্তাহে চার দিন আলেম দিয়ে দেয়া হয় কোরআন শিক্ষা, ছবি আঁকার ক্লাস হয় সপ্তাহে এক দিন, মাসে দুই দিন গান শেখানো হয়। এছাড়া হস্তশিল্প ও সেলাই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

আশ্রমটির বাসিন্দা নিশাত আক্তার বলেন, এখানে আমি তিন বছর আগে এসেছি। আমার মা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে, এজন্য এখানে এসেছি। এখানে খাবার খাচ্ছি, নতুুন কাপড় পাচ্ছি কোনো অসুবিধা নেই।

বৃষ্টি আক্তার নামে আরেকজন বলেন, এখানে থাকতে অনেক ভালো লাগে। আমি বড় হয়ে চাকরি করতে চাই। এখানে আমি বই পড়ি, আর্ট করি, টিভি দেখি, খেলাধুলা করি।

মেজিকা আক্তার সুখী নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, এখানে ক্লাস থ্রি থেকে আছি। বর্তমানে ক্লাস এইটে পড়ি। আমার মা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে তারপর এখানে চলে আসছি। আমার বয়সী আমার গ্রামের অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি যদি এতদিন বাড়িতে থাকতাম হয়তো আমারও বিয়ে হয়ে যেত। অথবা অন্য কোথাও কাজ করতাম।

আশ্রমটিতে রান্না ও দেখভালের দায়িত্বে থাকা মমিনা বেগম বলেন, এখানে রান্না করি খুব ভালো লাগে। এখানে প্রায় ১২ বছর ধরে কাজ করছি। রান্নার পাশাপাশি বাচ্চাগুলোর দেখাশোনা করি। কারো অসুবিধা হলে হাসপাতালে নিয়ে যাই।

আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা পিজিরুল আলম দুলাল বলেন, প্রথমে আমি ৫টা মেয়ে দিয়ে শুরু করি। পরে দেখা যায় আরও অনেকে মেয়ে দিতে চায়। এভাবে ১৫টা মেয়ে আসলো। ১৫টা মেয়ে দিয়ে এভাবে ৩-৪ বছর চলল। তারপর এক পর্যায়ে ৩৫টা মেয়ে হলো। আশ্রমের নাম পরে দেয়া হল চাঁদমনি। চাঁদমনি মানে চাঁদের মতো শিশু। এটা কোনো রেজিস্টার্ড প্রতিষ্ঠান না। আমরা কোথাও কোনো রেজিস্ট্রেশন করিনি। 

তিনি আরও বলেন, আশ্রমটিতে যারা ছিল বা থাকছে তারা দীর্ঘদিন ধরে আছে। কেউ ১০-১২ বছর ধরে, কেউ আবার ৩-৪ বছর ধরে। অনেকে আবার এক বছরে চলে গেছে। গড়ে ৪-৫ বছর ধরে থাকা মেয়ের সংখ্যা বেশি। মেয়েরা বিভিন্ন সময় আসছে গেছে। এরকম মেয়ের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। আর স্থায়ীভাবে যারা বসবাস করছে তাদের সংখ্যাও একশর বেশি। এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে গেছে এদের সংখ্যা দুইশ এর বেশি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছে কয়েকজন। আগের যে পরিমাণ মেয়ে আসতো আর যেত এখন কিন্তু অনেক কম আসে। করোনার পর থেকে দেখা যায় এখানে মেয়ে রাখার মানসিকতা কম। এর মূল কারণ হলো, তারা মেয়েদের গার্মেন্টসে পাঠাতে চায় বা কারো কাছে দিয়ে অর্থ উপার্জন করতে চায়। কয়দিন আগেও এখান থেকে দুইজন চলে গেছে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি উদ্দেশ্য হলো যে মেয়েরা এখানে থেকে যেন নিজেদের বর্তমান পৃথিবীর জন্য প্রস্তুত করতে পারে। আমি অবসরের পর ১৫ লাখ মতো টাকা পেয়েছিলাম, আমার নিজের পৈতৃক কিছু সম্পত্তি ও কেনা কিছু সম্পত্তি ছিল সব এখানে ঢেলে দিয়েছি। প্রথম ১০ বছর এখানে কোনো সাহায্যের প্রয়োজন পড়েনি। এছাড়া কিছু লোক আমাকে সাহায্য করে। আমার দুইটা ভাগ্নি আছে তারাও আমাকে এখানে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে।

আশ্রমটিতে রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আছে হলরুম ও লাইব্রেরি। নিজ নিজ কক্ষে রয়েছে চেয়ার-টেবিল। ক্লাসের বই পড়া ছাড়াও ছবি আঁকা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ছোট গল্প, উপন্যাস ও গুণীজনদের জীবনী পড়ার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।

নীলফামারী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, সমাজে অনেক বিত্তশালী মানুষ আছেন। যারা এসব মানবিক কাজে অর্থ ব্যয় করেন না। অথচ বৃদ্ধ বয়সে এসেও এই অনাথ শিশুদের আলোকিত করে তুলছেন দুলাল। এটি মহৎ উদ্যোগ। তার এই কাজে সবাইকে সহায়তার হাত বাড়ানো উচিত।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হামলায় মোল্লা কলেজের ৩ শিক্ষার্থী নিহত, দাবি কর্তৃপক্ষের - dainik shiksha হামলায় মোল্লা কলেজের ৩ শিক্ষার্থী নিহত, দাবি কর্তৃপক্ষের সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত নৈরাজ্যকারীদের প্রতিহত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ: সারজিস - dainik shiksha নৈরাজ্যকারীদের প্রতিহত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ: সারজিস মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে হবে: নুর - dainik shiksha অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে হবে: নুর কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051140785217285