গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ভূমিকম্পবিষয়ক একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে তিনি নামের আগে ড. ব্যবহার করেন। এরপর গত ১৪ মার্চ ‘পিএইচডি গ্র্যাজুয়েশন সিরিমনি’তে যাওয়ার জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ছুটির আবেদন করেন। এর আগে তার পিএইচডি সংক্রান্ত কোনো তথ্য রাজউক ও মন্ত্রণালয় জানত না। ২৭ মার্চ গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখা-৬ তাকে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে বলে। কিন্তু তিনি এখনো কিছু জানাননি। এমন অনিয়ম যিনি করেছেন তিনি হলেন রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুল লতিফ হেলালী। বুধবার (১৯ এপ্রিল) দেশ রূপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদটি লিখেছেন মতিন আব্দুল্লাহ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হেলালী রাজউকের যে প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি), সেই প্রকল্পের তথ্য ব্যবহার করেছেন তার পিএইচডি গবেষণায়। কিন্তু সেটা করার জন্য তিনি অনুমতি নেননি।
স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও সরকারি বিধি-বিধান প্রযোজ্য। কিন্তু রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুল লতিফ হেলালী সরকারের অনুমতি ছাড়া জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অব ফিলোসফি (পিএইচডি) কোর্সে ভর্তি হয়েছেন। নিজের নামের আগে ‘ডক্টর’ ব্যবহার করেছেন সরকারের অনুমতি ছাড়াই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজউক ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইয়ে আরবান রেজিলিয়েন্স নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিতকরণ, ঝুঁকি সংবেদনশীল ভূমি পরিকল্পনা, প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ, রাজউকের অনলাইন সেবা কার্যক্রমের সফটওয়্যার প্রণয়ন করা ছিল এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। রাজউকের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার এসব কাজ করতে প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। পাশাপাশি দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের খরচ হচ্ছে ৫৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার ৩৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা দিয়েছে। আর বিশ্বব্যাংক থেকে ৫৩২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আগামী ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তবে প্রকল্পের অগ্রগতি কাক্সিক্ষত মানের না হওয়ায় সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারের ঊর্ধ্বতন দপ্তরে কোনো তথ্যও হস্তান্তর করেননি প্রকল্প পরিচালক। রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের কাজের পরিধি এবং প্রকল্প পরিচালকের পিএইচডির গবেষণার বিষয় একই ধরনের। প্রকল্পের তথ্যের বাইরে তার গবেষণায় নতুন তেমন কিছু নেই।
আরও জানা গেছে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পের সব তথ্য-উপাত্ত সরকারের সম্পদ। এসব তথ্য-উপাত্ত কাউকে দেওয়া বা প্রকল্প পরিচালকের কোনো কাজে ব্যবহার করতে হলে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে।
রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, হঠাৎ করে রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আবদুল লতিফ হেলালীর নামের আগে ড. লেখা দেখে বিস্মৃত হয়েছেন তার সহকর্মীরা। কবে অনুমোদন নিয়েছেন, কবে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এর কিছুই জানতেন না তারা।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখা-৬ প্রকৌশলী হেলালীকে সেখানে জানতে চাওয়া হয়, আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত, ফলাফল গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে কি না? আর ব্যক্তিগত গবেষণায় ব্যবহার হয়ে থাকলে পূর্বানুমোদন নেওয়া হয়েছে কি না? এ ছাড়া জানতে চাওয়া হয়েছে, আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের কোনো সংস্থান ছিল কি না। তার গবেষণার অর্থায়ন ওই প্রকল্প থেকে হয়েছে কি না। হয়ে থাকলে অর্থের পরিমাণ এবং সরকারের অনুমোদনের প্রমাণপত্র দেখাতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি পিএইচডির প্রপোজাল সরকার থেকে অনুমোদিত কি না, কোর্সটি কত বছর মেয়াদের তার সুনির্দিষ্ট তারিখ ও প্রমাণ জমা দিতে বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কি না। একই সঙ্গে অনলাইনে পিএইচডি করার বিষয়ে পূর্বানুমোদন নেওয়া হয়েছে কি না, হয়ে থাকলে তার প্রমাণপত্র দিতে বলা হয়েছে।
অভিযোগ বিষয়ে রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের পরিচালক আবদুল লতিফ হেলালী বলেন, ‘মন্ত্রণালয় আমাকে চিঠি দেবে কেন? মন্ত্রণালয়ের কাছে তো আমি চিঠি লিখিনি। চিঠিতে যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে, সেই সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। সাবেক সচিবের কাছ থেকে আমার একটি অনুমোদন নেওয়া আছে। তবে সেটা গবেষণা শুরুর দুই থেকে আড়াই বছর পরের। বিশ্ববিদ্যালয় যখন চেয়েছে, তখন নিয়েছি। শুরুতে প্রয়োজন হয়নি বলে নিইনি।’
সরকারের প্রকল্পের তথ্য নিজের গবেষণায় ব্যবহার প্রসঙ্গে হেলালী বলেন, ‘প্রকল্পের সব ধরনের কাজের সঙ্গে তো আমি জড়িত ছিলাম। এ জন্য এই গবেষণা আমি আমার কাজে ব্যবহার করতে কোনো দোষ দেখি না। আর প্রকল্পের একটি অংশও ছিল যে এসব তথ্যের উচ্চতর গবেষণা করতে হবে। জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি কি যেনতেন ব্যাপার। রাজউক ও মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা আমাকে ঝামেলায় ফেলতে চিঠি ইস্যু করে আমার জিও (সরকারি আদেশ) আটকে রেখেছে। ওরা যা করে করুক ইতিমধ্যে আমার পিএইচডির সব কাজ শেষ করেছি। আর অল্প কিছুদিন চাকরি আছে। কাউকে এত তোয়াজ করতে পারব না।’
জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, ‘এক বছর তিন থেকে চার মাস আগে সাবেক সচিবের কাছ থেকে হেলালী একটি সনদ নিয়েছেন। সেটা ফাইলের মাধ্যমে করালেও সেটা মূলত একটি সনদ। কিন্তু হেলালী পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হয়েছেন ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে এমন দাবি তার। সেই সময় তো কোনো অনুমোদন নেয়নি। আর সরকারের প্রকল্পের তথ্য তার গবেষণা হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন। সেসব তথ্য তিনি সরকারকে দেওয়ার আগে কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এমন কাজ কখনো করতে পারেন না। আর সাবেক সচিবের সনদকে অনুমোদন ধরলেও তার পিএইচডির সময়কাল ১ বছর ৩ মাস। এত অল্প সময়ে তো পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব নয়।’