প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা নতুনদের সুনাগরিক করতে পারছে কি?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হলে শিক্ষকেরও মান বাড়াতে হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে শিক্ষককে অপমানিত করে সেটি করতে হবে। যেমনটি করা হয় সাধারণত শিক্ষার্থীকে নানাভাবে শাস্তি দিয়ে, অপমানিত করে। যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে এ ধরনের অ্যাপ্রোচ চলে আসছে, যা একটি জনগোষ্ঠী বা জাতির মেরুদণ্ডকে আজীবনের জন্য পঙ্গু করা ছাড়া আর কিছু না। ফলস্বরূপ, বিবেকের দরজা বন্ধ করে আজ সেসব শিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা দেশের অকল্যাণ করছে। অপমান করে দেয়া শিক্ষা সুশিক্ষা নয়, সেটা প্রতিহিংসাপরায়ণ শিক্ষা, যার কারণে বাংলাদেশের সব খাতে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে জয়ী হওয়ার প্রবণতা নেই। আছে  শুধু প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা এবং দুর্নীতি করার মনোভাব। বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করা যাক। ধরা যাক,  কোনো স্থানে বর্জ্য রাখা হলো। সেখানে তা পচে জৈব সার হয় ঠিকই, তবে পদ্ধতিটির শুরুটা হয় নানা রকম  পোকা জন্ম  নেয়ার মাধ্যমে। যদিও পরে সেটা অন্য জীবজন্তুর খাবার হিসেবে ব্যবহূত হয় এবং শেষে জৈব সার হিসেবে ব্যবহূত হয় কৃষি খেতে। একইভাবে দেশের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা শিক্ষিত তারাই শেষে ব্যবহূত হচ্ছে দেশ গঠনে। কিন্তু তার ফলাফল কী তা আজ আমরা সবাই দেখছি।

একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে শিক্ষা কাঠামোয় প্রবেশে চাপও বাড়ছে। জনসংখ্যা দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তার ফল কিন্তু মনঃপূত হবে না। যেমন শিক্ষাপদ্ধতিতে প্রচুর শিক্ষার্থী ঝরে যাচ্ছে অকালেই। পঞ্চম শ্রেণীর পর অনেক হারিয়ে যায়। অষ্টম, দশম, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসা লাইনেও এ রকম অনেকে ঝরে যাচ্ছে। অনেকে মুখস্তের চাপ সামলাতে না পেরে পালিয়ে যায়, শিক্ষা ওখানেই শেষ। অনেকে হুজুরের পিটুনি দেখে পালায়। তারপর বড় কষ্ট হচ্ছে জেনে, দেশে এতিমদের দেখার বা পরিচর্যা করার কোনো সুব্যবস্থা নেই। ইদানীং যেখানে-সেখানে গড়ে উঠছে এতিমখানা, মাদ্রাসা ও স্কুল। সরকারি অনুমোদন থাকুক বা না থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না। সরকারও পর্যবেক্ষণ করে না এদের। এসব সন্তানের লেখাপড়া কতদূর গিয়ে ঠেকে, কী শেখে, এসবেরও কেউ খোঁজ নেয় না। অথচ তাদের দিয়েই রাস্তায় বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা তোলা হয়, শুধু এতিম বলেই এ অবস্থা। তাদের দিকে কি নজর দেয়া উচিত নয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের? শিক্ষা, শিক্ষার মান এবং নীতি-নৈতিকতার এ অধঃপতনের পেছনে এ রকম শত শত কারণ রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এতটা দূরের পথ পর্যন্ত ভাবতে শেখায় না।

এছাড়া আমরা যেমনিভাবে অন্যের মতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচনা করতে চাই না, ঠিক একইভাবে নতুন করে কোনো কিছু জানতে পারার মধ্যে যে আনন্দ, সেটিকেও আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি না। কেবল পরীক্ষায় পাস করি, কিন্তু শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য আমরা অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। একটি দেশের পাঠ্যক্রমে কী কী বিষয় থাকা উচিত, তা নির্ধারিত হয় সে দেশের সমস্যা, সংকট, চাহিদা ও সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে।

আর্থসামাজিক  প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। এমনকি একটা বড় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেও এগুলো আলাদা হতে পারে। সময়ের ব্যবধানে সেটাও পরিবর্তিত হয়। আমাদের দেশের সমস্যা, সংকট, চাহিদা, সম্ভাবনা ও সামর্থ্য কী, তা নিয়ে কি কখনো বৃহৎ পরিসরে গবেষণা হয়েছে? আমাদের জাতীয় পাঠ্যক্রম ও টেক্সটবুক বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিসের ভিত্তিতে নিয়মিত সিলেবাস পরিমার্জন করে? এসব পাঠ্যক্রম দিয়ে কি আমরা উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করতে পেরেছি?

বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবাদাতাদের আচরণ, ভদ্রতাবোধ, সততা, কাজের দক্ষতা ও আন্তরিকতায় পেশাদারত্ব বিবেচনা করলে উত্তরটা জানা যায়। পরতে পরতে আমাদের অপেশাদারত্ব ধরা পড়ে। সেবাগ্রহীতাও একই রকম পরিচয়ের স্বাক্ষর রাখেন কারণ আমরা সবাই একই শিক্ষা ব্যবস্থার ফসল। শুধু চাকরিজীবী নন, প্রায় সব পেশাজীবীর মধ্যেই এ ঘাটতি রয়েছে।

অতীতের মতো হুট করে সুইডিশ শিক্ষাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করার সাহস কিছুটা হারিয়ে ফেলেছি ইদানীং। কারণ এ যুগে যুদ্ধ, অমানবিক এবং হূদয়হীন ব্যবহার বারবার লক্ষ করা যাচ্ছে, যার সঙ্গে কমবেশি সবাই জড়ি। বিশেষ করে আমেরিকার নৈতিকতার অবনতি দেখে এখন আর তাদের শিক্ষাকেও বড় করে দেখতে ইচ্ছে করে না। তবে এই নিরাশার মধ্যেও একটা আশার কথা  শোনাব।  সেটা হলো সুইডেনের মানুষের নৈতিকতাকে এখনো অধঃপতন গ্রাস করেনি। কাজেই এখানকার শিক্ষার ধরনটাকে আমি তুলে ধরব।  এখানে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি বন্ধুসুলভ পরিবেশ রয়েছে, যা পরস্পরকে যেমন সৃজনশীলতা শেখায় একই সঙ্গে সামাজিক এবং নৈতিকতাকেও প্রসারিত করে। শুধু শিক্ষক নন, বাড়িতেও কিন্তু তারা বাবা-মার সঙ্গে বন্ধুসুলভ হয়ে থাকে। ফলে পরস্পরের সম্পর্কটি বেশ মধুর হয়। বাবা-মার ভয়ে কিছু করব না বা কিছু গোপন রাখতে হবে, এমনটি শিক্ষা তাদের মধ্যে ঢোকেনি। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাদের মোরাল ভ্যালুর অবনতি হয়নি। এ সহজ বিষয়টি তারা ধরে রেখেছে সততার মধ্য দিয়ে। এখন এ সততা যদি আমরা প্রতিনিয়ত ঘরে, বাইরে, অফিসে, আদালতে, রাস্তাঘাটে প্র্যাকটিস করি, তবে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি বিশাল পরিবর্তন লক্ষ করতে সক্ষম হব।

সততাকে আমরা আমাদের ব্র্যান্ড নেম হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আমি এটা বিশ্বাস করি, কারণ আমি নিজে এর ওপর প্র্যাকটিস করে চলছি এবং এতে আমার প্রতি সবার একটা আস্থা জন্মেছে। তারপর যখন কথা প্রসঙ্গে অনেকে জানে আমি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত, নিশ্চিত তাদের একটা ভালো ধারণা হয় আমার সম্পর্কে। এ ছোট্ট অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি বাংলাদেশ তার পরিচয় নতুন করে গড়তে পারে।  সেক্ষত্রে স্লোগান হিসেবে  ব্যবহার করতে পারে: আমরা বাংলাদেশী এবং সততা আমাদের বৈশিষ্ট্য। বিনা খরচে এত বড় একটা কাজ করার যোগ্যতা আমাদের আছে। আমরা জানি, অসৎ কাজগুলো কী, এখন শুধু বিপরীতটা হলেই জয়ী আমরা হবই। অতএব, মিথ্যাকে মোরা করব না ভয়, আড়ালে তার সত্য আছে। এখন শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শেখা, জানা এবং সেটা প্রয়োগ করা। একে অন্যকে ছোট করে, কটু কথা বলে যদি আমরা কাউকে কিছু শেখাই তার ফল  যে ভালো হয় না তা  আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। এর ফলস্বরপ দেশে শিক্ষককে অপমান, দুর্নীতি করা ইত্যাদি চলমান রয়েছে। এখন এ শিক্ষা পদ্ধতি বর্জন করতে হবে, যদি আমরা সঠিক এবং সুশিক্ষা অর্জন করতে চাই। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের দ্রুত এক্ষেত্রে শুভবোধের উদয় হবে, এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, প্রডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, ফাইজার, সুইডেন


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034608840942383