প্রতিকূল সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু

এম এ ছিদ্দিক মিয়া |

৪৯ বছর ঘুরে ফিরে এসেছে বাঙালি জাতির বিজয়ের মাস। ত্রিশ লাখ শহীদ ও অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মাধ্যমে আমাদের এ বিজয়। এর মাধ্যমে বাঙালি জাতি পেয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ড। এ বিজয়ের আনন্দ যে কত গভীর তা প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া হৃদয়ঙ্গম করা দুরূহ। আজকের প্রজন্মের কাছে তা শুধু ইতিহাস।

স্বাধীনতার আগে এ দেশের মানুষ ছিল বৈষম্যের করাল গ্রাসে জর্জরিত। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার সম্পদ নিয়ে উন্নয়ন করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের। এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জীবনের দীর্ঘসময় কারাবরণ করতে হয়েছে। তার স্বপ্ন ছিল এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। এ দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলা।

তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন- গরিব কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে না পারলে এ স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সবকিছু ধ্বংস করে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল প্রায় শূন্য।

যানবাহনের স্বল্পতা, ব্রিজ, রাস্তাঘাট প্রায় সবই বিধ্বস্ত। চারদিকে অন্ন,বস্ত্র, নিত্যপণ্য, ওষুধের নিদারুণ হাহাকার। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিলেও স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি, লুটতরাজ, হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে। প্রতিনিয়ত পাটের গুদাম,খাদ্যের গুদামসহ নানা স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডের খবর সংবাদপত্রে শিরোনাম হচ্ছে।

এমন এক অবস্থার মাঝে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। তিনি ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে প্রায় দেড় লাখ প্রাথমিক শিক্ষককে সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা প্রদান করেন। এটি সম্ভব হয়েছিল দেশের তথা মানুষের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার কারণে। তিনি একাধারে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, ইতিহাসের মহানায়ক ও বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করে দুঃসাহসী পদক্ষেপ নেন তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শের পথে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যার আরেকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য, তা হল প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণ।

স্বাধীনতার আগে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ভাঙা চাল, বেড়া বা বেড়াবিহীন অবস্থায়। কবির ভাষায় বলতে হয়-‘একটুখানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পড়ে পানি।’বৃষ্টির পূর্বাভাস বা লক্ষণ দেখা দিলে স্কুল ছুটি। সে সময় প্রাথমিক শিক্ষকরা খালি পায়ে, লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে বিদ্যালয়ে আগমন/প্রস্থান করত। গ্রামে-গঞ্জে তখন জুতা বা স্যান্ডেলের ব্যবহার খুবই নগণ্য ছিল। কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে গেলে সচরাচর পাঞ্জাবিটি কাঁধে ঝুলিয়ে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে যেত।

আত্মীয় বাড়িতে পুকুরঘাটে হাত-পা ধুয়ে স্যান্ডেল পরে, জামা পরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করত। বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্ররা লুঙ্গি পরে খালি পায়ে স্কুলে যেত। হতভাগা প্রাথমিক শিক্ষকদের থলি হাতে নিয়ে হাটবারের দিন পোস্ট অফিসের পিওনের কাছে বেতনের টাকার জন্য ধরনা দিতে হতো। পোস্ট অফিসের পিওন ভেঙে ভেঙে হাটবারে বেতনের টাকা দিত। যেদিন টাকা না পেত, সেদিন প্রাথমিক শিক্ষকদের দুঃখভরা মনে বাজারবিহীন বাড়ি ফিরতে হতো। এ বছরের জানুয়ারি থেকে সব শিক্ষকের বেতন ইএফটির মাধ্যমে ১-২ তারিখে সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এসে জমা হবে। কোথায় এসেছে আজকের প্রাথমিক শিক্ষা! তবে এখনও প্রাথমিক শিক্ষা নানা বৈষম্যে জর্জরিত। অপরদিকে একশ্রেণির দুর্নীতিপরায়ণ নেতা ও কতিপয় কর্মকর্তা দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি আজও।

এতদসত্ত্বেও বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের মর্যাদা আজ কোথায় পৌঁছেছে, তা নিয়ে বিজয়ের মাসে এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের একটু ভেবে দেখা দরকার। একবার বেসরকারি ননএমপিও শিক্ষকদের কথা চিন্তা করা হোক। এমপিও শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা সবকিছু অতি নগণ্য। বেশিরভাগ বেসরকারি শিক্ষক জীবিকা অর্জন করেন কোচিং করে অথবা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে। আজ মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী,মহান মুজিববর্ষে বিজয়ের মাসে আমাদের মাঝে আশীর্বাদ হয়ে আসুক প্রাথমিকের বাইরে সব শিক্ষা জাতীয়করণের উদ্যোগ। শিক্ষকদের সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি- এ বৈষম্য কোনোক্রমেই কাম্য নয়। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষকের মর্যাদা থাকুক প্রথম শ্রেণির। দ্বিতীয় শ্রেণি, তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদার অভিশাপমুক্ত হোক শিক্ষক সমাজ। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ সব বৈষম্যের অবসান হোক।

 

লেখক : এম এ ছিদ্দিক মিয়া, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ, ঢাকা মহানগর শাখা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026438236236572