‘আমার জীবনের যত সাধনা, আকাঙ্ক্ষা সব ফানুসের মত চুপসে গেল শুধুমাত্র একটি টেলিফোনে। তখনও ভাবতে পারিনি আমার রাজু মারা গেছে! সৃষ্টিকর্তার কাছে ওর প্রাণ ভিক্ষে চাইতে চাইতে ছুটে গেছি মেডিকেলে। দেখতে দিল না আমাকে। বাবু (বড় ছেলে) কাঁদছে আমাকে জড়িয়ে ধরে। রাজুর বন্ধুরাও কাঁদছে। ওরা আমাকে বাসায় চলে যেতে বলছে। ডাক্তার নাকি সুস্থ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। রাজু একটু সুস্থ হলেই বাসায় নিয়ে আসবে ওরা। তখনও বুঝতে পারিনি তপ্ত বুলেট ওর মাথা ভেদ করে কপাল দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’ কথাগুলো গত বছর সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন রাজুর মমতাময়ী মা খাদিজা বেগম।
[inside ad] এ বছর শহীদ মঈন হোসেন রাজু দিবস আমাদের কাছ আরেকটু বেদনাঘন হয়ে উপস্থিত হলো। গত বছরের ৫ অক্টোবর রাজুর মা আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন। ক্যান্সারে ভুগছিলেন দীর্ঘদিন। হয়তো ২৩টি বছর যাবৎ ছেলের শোকে কাতর মা রোগ নিরাময়ে যথেষ্ট মানসিক শক্তিটুকু আর পাচ্ছিলেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের কৃতি শিক্ষার্থী ছিলেন মঈন হোসেন রাজু। ১৩ মার্চ ১৯৯২ সাল। সেদিনকার শুক্রবার দিনটি অন্যান্য শুক্রবারগুলোর মতই সাদাসিধে একটা দিন। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় মায়ের আশা ছিল সন্তান প্রত্যেক দিনের মতো আজো বাসায় গিয়ে দুপুরের খাওয়ার খাবে। কিন্তু মা জানেন না যে আজ থেকে তার সন্তানটি আর বাসায় খেতে যাবেনা।
সেদিন একজন ছাত্রদল কর্মীর প্রহৃত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় সাধারণ ছাত্রদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে ঐ সময়ে রাজুর কনুইতে আঘাত লাগে; তাই বাসায় না গিয়ে শহীদুল্লাহ হলে নিজের ১২২ নং কক্ষে বিশ্রাম নিতে যান রাজু।
অন্যদিকে বিকেল হতে না হতেই ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে শুরু হয় ক্যাম্পাস দখল নিয়ে গোলাগুলি। সেই সময় গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে রাজু প্রতিবাদ জানাতে উন্মুখ হয়ে ওঠেন। সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল, গুলির মুখে দাঁড়িয়েও সন্ত্রাসের ভিত্তিমূলকে উপড়ে ফেলার প্রতিজ্ঞায় শক্ত হয়ে ওঠে রাজুর চোয়াল। সেই মিছিলে রাজুকে লক্ষ্য করে অকস্মাৎ ছুটে আসে বুলেট- বুলেটবিদ্ধ রাজুর রক্তে রঞ্জিত হয় টিএসসির সামনের রাজপথ। রাজুকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত সাড়ে দশটার সময় সকলকে কাঁদিয়ে, প্রতিবাদের সাহসী ভাষা শিখিয়ে মঈন হোসেন রাজু আলিঙ্গণ করেন মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ।
আর এমনই ঘটনায় প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে রাজুর রাজপথের সারথিরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভও করে তারা। কিন্তু সকলকে কাঁদিয়ে চিরতরে রাজু স্বপ্নময় পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও আজো রয়ে গেছে তার সেই কৃর্তিময় আদর্শ। সেই আদর্শে কাজ করে যাচ্ছে আজো অসংখ্য সাথীরা। যে আদর্শ, ছাত্র অধিকার ও চেতনার জন্য সেদিন রাজু নিজের জীবনকে বুলেটের কাছে বিলিয়ে দিয়েছিলেন আজ সেই আদর্শ বাস্তবায়নে কতটুকু কার্যকরী তার স্বপ্নের সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন? সেটাই এখন প্রশ্নের বিষয়। তবে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাসান তারেক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা রাজুর সন্ত্রাসবিরোধী সেই চেতনাকে ধারণ করে কাজ করে যাচ্ছি। আজকের সময়ও আমরা তার সেই আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করছি। তবে আমাদের কাজকে আরো জোরদার করা উচিত এবং আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।’
রাজুর সন্ত্রাসবিরোধী বিপ্লবী চেতনাকে জাগ্রত রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আতাউদ্দিন খান (আতা খান) ও মুন্সিগঞ্জ এর বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি লায়ন নজরুল ইসলাম খান বাদলের আর্থিক সহযোগিতায় ১৯৯৭ সালে টিএসসির সড়ক মোড়ে সন্ত্রাসবিরোধী ‘রাজু ভাস্কর্য’ নামে একটি ভাস্কর্য নির্মণ করা হয়। ভাস্কর্যটির নির্মাণ শিল্পী ছিলেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী এবং তার সহযোগী হিসেবে ছিলেন গোপাল পাল। নির্মাণ কাজের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। নির্মাণ কাজ শেষে ১৯৯৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. কে. আজাদ চৌধুরী এই ভাস্কর্যের উদ্বোধন করেন।
রাজু ভাস্কর্য সম্পর্কে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাসান তারেক জাগো নিউজকে বলেন, ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য শুধু একটি ভাস্কর্য নয়। এটি একটি চেতনার শিল্প নির্মাণ করেছে। যে চেতনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক জাগ্রত চেতনাকে লালন করে।’
কে এই রাজু : পুরো নাম মঈন হোসেন রাজু। বাবা-মোয়াজ্জেম হোসেন, মা-খাদিজা বেগম। ১৯৬৮ সালের ২৯ জুলাই বরিশালের মেহেদীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তবে রাজুর পরিবার প্রথমে চট্টগ্রাম ও পরে ঢাকাতে বসবাস করে। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারেই। ১৯৮৭ সালে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।
ঢাকাতে বসবাস করার সময়ে রাজু শের-ই-বাংলা নগরে যুক্ত হন প্রগতিশীল ছাত্র-সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাথে। এরপর সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে একে একে শের-ই-বাংলা নগর ও তেজগাঁও কলেজে কাজ করেন। তেজগাঁও থানা কমিটির অন্যতম এই নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যুক্ত হন ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাথে। ভর্তি হয়ে ৯০’র স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এরপর একে একে ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
রাজু শুধু যে নিজেকে সারাক্ষণ আন্দোলন সংগ্রামে ব্যস্ত রাখতেন তাও নয়। তার ছিল পড়া লেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ। অন্যদিকে সংগঠনের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার নমুনা রেখে গেছেন জীবনের ক্রান্তিলগ্নেও। ১৩ মার্চ ১৯৯২ সালে গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময়ও স্লোগানরত রাজুর কাঁধে যে ব্যাগটি ছিল সেই ব্যাগে ছিল নোটখাতায় নিজ হাতে টুকে রাখা জীবনানন্দের কবিতা এবং রং করার ব্রাশ ও হকিয়ার। সেই দিনের শহীদ রাজুর রক্তমাখা শার্ট ও ব্যাগ এখনো সংরক্ষিত রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সংগ্রহশালায়।
মৃত্যুর আগে মাকে বলতেন, ‘দেখো, একদিন আমার পরিচয়ে তুমি পরিচিত হবে।’ সেটিই হয়েছে আজ রাজুর নামেই তার মাকে চিনতে পারে সকলে। আজ রাজু বেঁচে নেই। কিন্তু রয়েছে তার রেখে যাওয়া চেতনা। যে চেতনা এখনো লক্ষ কোটি ছাত্রজনতাকে শিক্ষা দেয় প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ কিভাবে প্রজ্জ্বলিত করতে হয়। সে চেতনার সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সড়ক মোড়ে ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য’। যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ষোল কোটি মানুষকে শিক্ষা দেয় কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়।