প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর : বিনিয়োগ আকর্ষণে করণীয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ ও সুযোগ্য নেতৃত্বে জাপান-বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন নতুন উচ্চতায়। বন্ধুত্ব, আস্থা, পারস্পরিক সহযোগিতা ও অংশীদারত্বের ওপর স্থাপিত এই সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন মজবুত। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্বলতাগুলো প্রশমনে জাপান বাংলাদেশকে সহায়তা করে আসছে। বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে জাপানকে সমর্থন করেছে। আগামী ২৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সফরে জাপানে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটা তার ষষ্ঠ জাপান সফর। শুক্রবার (২১ এপ্রিল) দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম বিশ্বস্ত সঙ্গী জাপান। ঢাকা মাস রেপিড ট্রানজিট প্রকল্প, মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুত্, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, যমুনা রেল সেতু, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প এবং বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কৃষি, পল্লী উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, পরিবহন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায়। জাপানের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে নির্মিত হয়েছে একমাত্র বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা। বর্তমানে বাংলাদেশে তিন শতাধিক জাপানি কোম্পানি চালু রয়েছে। বিনিয়োগকে কখনো শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে না জাপান। ভৌগোলিক ও সার্বভৌমত্ব নিরাপত্তার স্বার্থেও জাপান গুরুত্বপূর্ণ।

চালকের আসনে বাংলাদেশ

সম্প্রতি ভারত সফরে গিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দর ঘিরে নতুন একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রস্তাবিত শিল্পাঞ্চল মূলত নেপাল, ভুটান ও ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে রপ্তানির জন্য পণ্য উৎপাদন করা হবে। বঙ্গোপসাগর ঘিরে এই অঞ্চলের বন্দর ও পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে একটি ‘সাপ্লাই চেইন’ তৈরি করতে চায় জাপান। ধারণা করা হয়, বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলকেন্দ্রিক ৩০ কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এই উদ্যোগ। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সাপ্লাই চেইন হলে বাংলাদেশ থাকবে চালকের আসনে। 

ভূরাজনৈতিক সুবিধার কার্যকর ব্যবহার

বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে। আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ছে এবং বাড়বে। হাতছানি দেওয়া সুবিধা পেতে আমাদের কূটনৈতিক দক্ষতা কাজে লাগানোর পাশাপাশি অবকাঠামোগত সুবিধাকে সংহত করতে হবে। মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে ত্রিপুরা। ফলে ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে রপ্তানিকারকদের প্রবেশদ্বার হতে পারে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর। এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতেও বাংলাদেশ থেকে পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হবে। এই পরিকল্পনা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং জাপান ও অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ আনতে সহায়ক হবে। দুই দেশের মধ্যে অংশীদারত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশে শিল্প উৎপাদন আরও বাড়বে, বিদেশি কোম্পানিও বিনিয়োগে আকর্ষিত হবে।

মানবসম্পদ উন্নয়ন

এ দেশের রয়েছে বিশাল মানবসম্পদ। তবে রয়েছে দক্ষ জনবলের অভাব। জাপান বাংলাদেশের প্রতি মনোযোগী হওয়ায় বাংলাদেশের শিল্প খাতে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেজন্য দক্ষ শ্রমশক্তি অপরিহার্য। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষা কারিকুলামে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।

শক্তিশালী অবকাঠামো

বিদেশি বিনিয়োগ সম্ভাবনার সুফল লাভ করতে হলে ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোর সঙ্গে শক্ত অবকাঠামো বা ‘হার্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক শিল্পায়িত জাতির কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয় নেটওয়ার্ক এবং ‘নরম অবকাঠামো’ বা ‘সফট ইনফ্রাস্ট্রাকচার’; তথা সরকারব্যবস্থা, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মান বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করতে হবে।

বাণিজ্য উন্নয়নে বিশেষায়িত সংস্থা

বাংলাদেশে বাণিজ্য সম্পর্কিত নীতিমালায় এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় দুর্বলতা রয়েছে। বাংলাদেশকে আমদানি বা রপ্তানিনীতির পরিবর্তে বাণিজ্য উন্নয়ন নীতি চালু করতে হবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর’ রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমলের তৈরি। আমদানি নিয়ন্ত্রণের আবেদন বহু আগেই ফুরিয়েছে। ‘বাণিজ্য উন্নয়ন’ ধারণাটি বাংলাদেশে নতুন হলেও বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের এজেন্সি রয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উন্নয়নে নিবেদিত একক এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করেছে। জাপান বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে ‘জেত্রো’ (জেইটিআরও—জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন) প্রতিষ্ঠা করেছে। এর অনুসরণে দক্ষিণ কোরিয়া ‘কোটরা’ (কেওটিআরএ—কোরিয়া ট্রেড ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সি) প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের অপরাপর দেশের মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রচারের কাজ করছে। একই আদলে কমিউনিষ্ট দেশ ভিয়েতনাম ‘ভিয়েট্রেড’ (বিআইইটিআরএডিই-ভিয়েতনাম ট্রেড প্রমোশন এজেন্সি) প্রতিষ্ঠা করেছে। উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পেশাদার জনশক্তি দ্বারা পরিচালিত এই সংস্থাগুলো নিজ নিজ দেশের বৈশ্বিক আমদানি-রপ্তানি সম্ভাবনা উন্নয়নে সহায়তা করে থাকে। বাংলাদেশে এ ধরনের বিশেষায়িত সংস্থা প্রয়োজন।

ভিয়েতনাম উদাহরণ

১৯৭৩ সালে ভিয়েতনাম সরকার অর্থনৈতিক নীতিতে সংস্কার করে। দেশে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতি এবং পরিচালন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়। উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সে দেশের বাজার। বিদেশি কোম্পানিগুলোকে দেওয়া হয় নানা সুবিধা। ফলে ভিয়েতনাম বিদেশি বিনিয়োগে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। এটা সম্ভব হয়েছে মূলত বিনিয়োগের কারণে ভিয়েতনাম দশকের পর দশক ধরে কাঠামোগত সংস্কার করেছে, যার সুফল তাদের উন্নতির দিকে নিয়ে গেছে। আমরা ভিয়েতনাম থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

এগিয়ে যেতে হলে

পরিবর্তিত বিশ্বে টিকে থাকতে ব্যাপক পরিবর্তনের বিকল্প নেই। আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর, ইপিবি এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর রয়েছে। এসব এজেন্সির কার্যক্রম সীমিত। এগুলোর সমন্বয়ে একক এজেন্সি/কর্তৃপক্ষ হওয়া সমীচীন। এমনকি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা ‘বিডা’র (বিআইডিএ) সঙ্গে অঙ্গীভূত করা যেতে পারে।

একসময়কার পশ্চাত্পদ দেশ চীনের বিস্ময়কর উত্থান আমাদের সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ। গত ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে চীন তাদের বাজার অর্থনীতিতে যুগান্তকারী সংস্কার ঘটিয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য নতুন নতুন দ্বার খুলে কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের কবল থেকে উদ্ধার করেছে। বাজারব্যবস্থার সুফল লাভ করতে হলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশকে আরও বেশি কৌশলী হতে হবে। তবেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত হতে পারে আরও নির্ভরযোগ্য।

জাপানি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে করণীয়

শুধু জাপানি ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে দুই সপ্তাহের জন্য অন অ্যারাইভাল ভিসা ব্যবস্থা; ঢাকা ও টোকিওর মধ্যে সরাসরি এয়ার সার্ভিস চালু। জাপানি অটোমোবাইল শিল্প স্থাপনের প্রস্তুতি হিসেবে অটোপার্টস সহায়ক শিল্প স্থাপন। জাপানি শিপব্রেকিং শিল্পকে আকৃষ্ট করতে মাতারবাড়ী/মহেশখালী এলাকায় শিপব্রেকিং তথা ইস্পাত শিল্প কারখানা স্থানান্তর। মাতারবাড়ী এলাকায় কনটেইনার ফিডার সার্ভিস স্থাপনের জন্য জাপানি লজিস্টিক কোম্পানিকে বিনিয়োগে উত্সাহ প্রদান। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার করবে। বাংলাদেশের সুযোগ রয়েছে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার। প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি ও বিনিয়োগ আকর্ষণে সুবিধা প্রদান।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ভারতে গিয়ে ভারত ও বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে এগোনোর ঘোষণা দিয়েছেন। জাপানের প্রধান লক্ষ্য বঙ্গোপসাগরীয় এলাকার অপার সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে গোটা অঞ্চলকে স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী করে তোলা। ভারতকে বাংলাদেশের কাছে নিয়ে এসেছে জাপান। এটা বাংলাদেশের জন্য অনন্য সুযোগ। গভীরভাবে এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুই দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী প্রতিষ্ঠার প্রথম রূপকার। তিনি কাজ সমাপ্ত করার সময় পাননি। আশা করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মহান পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে ইতিহাসে নাম লেখাবেন।

লেখক: আবদুল হক, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, জাপান বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (জেবিসিসিআই); উপদেষ্টা, এফবিসিসিআই


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের - dainik shiksha ‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক - dainik shiksha পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন - dainik shiksha প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0057101249694824