প্রধানমন্ত্রীর নামের প্রতিষ্ঠান চালু হলেই সরকারি হবে এমন আশায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘শেখ হাসিনা টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ’। প্রতিষ্ঠানটি পাঠদানের অনুমিত পায়নি। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমোদন ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে খোলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আর সবকিছুর মূলেই রয়েছে কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য। ঘটনাটি নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার নগর ইউনিয়নের ছোট পিঙ্গুইন গ্রামে।
সরেজমিনে শেখ হাসিনা টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে গিয়ে দেখা গেছে, সাইনবোর্ডে প্রতিষ্ঠার বছর লেখা হয়েছে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, কলেজের ঘর করা হয়েছে গত বছরের মার্চ মাসের দিকে। আবার নাম বদলে সাইনবোর্ড লেখা হয়েছে ‘শেখ হাসিনা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট’। প্রতিষ্ঠার সাত বছর পর এবারই প্রথম ভর্তি বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়ে শুরু করা হয়েছে ভর্তি কার্যক্রম। যেখানে ১ম থেকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নামে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ইতোমধ্যে অনেকেই ভর্তি ফরম নিলেও ১১জন শিক্ষার্থী ভর্তি ফরম জমা দিয়েছেন। ইলিয়াস নামে দায়িত্বরত ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, প্রতিদিন দুইজন স্টাফ পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের মোট শিক্ষক-কর্মচারী ১২-১৪ জন হবে বলে তিনি শুনেছেন। তবে সবাইকে চেনেনা না। ক্লাস শুরু হলে সবারই আসার কথা রয়েছে। ইলিয়াস আরও জানান, তাকে ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট পদ দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে নিয়োগপত্র দেয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা বড়াইগ্রাম উপজেলা সহকারী পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার। তার বাড়ি ছোট পিঙ্গুইন গ্রামেই। আর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার জামাতা মো. মনিরুল ইসলাম। কথা বলার সময় সেখানে হাজির হন আব্দুস সাত্তারের বড়ভাই আখতার হোসেন। তিনি বলেন, এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের পথ সুগম করতেই এই প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে।
তবে এ প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ রাতারাতি স্কুল খুলে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের নামে অবৈধ বাণিজ্য চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। বড় পিঙ্গুইন গ্রামের বাসিন্দা জোনাইল ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক লুৎফর রহমান বলেন, স্থানীয় হওয়ায় বিভিন্ন সময় অনেক অভিভাবক আমার কাছে এসেছেন। তার জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আব্দুস সাত্তার তাদেরকে বলেছেন, শেখ হাসিনার নামে প্রতিষ্ঠান পাঠদানের অনুমতি পেলেই সরকারি হয়ে যাবে। আর পাঠদান সামনের জানুয়ারি মাসেই পেয়ে যাবে। আর আমরাও শুনেছি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে সরকারি ঘোষণা শুরু হয়েছে। তাই টাকা যা লাগুক ভবিষ্যতের কথা ভেবে সন্তানকে ঘুষ দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে দিয়েছেন তারা।
একই গ্রামের আব্দুস সামাদ দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, প্রথমে একটা প্রাইমারি স্কুল করেছিলেন সাত্তার। কিন্তু সেখানে লাভ হয় নাই। তাই নয়া প্রতিষ্ঠানের নামে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি টাকা নিয়ে নিয়েছে। এখন প্রতিষ্ঠান হলেই কি আর না হলেই কি? তারতো সরকারি চাকরি আছেই।
উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের খোয়াজ আলী বলেন, আমার ভাই মাসুদ রানাকে কম্পিউটার অপারেটর পদে ঢুকাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ১০ লাখ টাকার কমে ঘুষ নেবে না। তাই পারলাম না। পরে আমার প্রতিবেশী দোয়েলকে ১০ লাখ টাকায় ঢুকিয়েছে। দোয়েল প্রথমে ৫ লাখ দিয়েছে।
নগর গ্রামের রাসেল আহমেদ দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আমাকে ইন্সট্রাক্টর পদে ঢুকাতে ১২ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল। আমি ৫ লাখ দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু নেয়নি।
ছোট পিঙ্গুইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান এবং বড় পিঙ্গুইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিউল আলম দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, সরকারি নীতিমালা না মেনে ক্যাচমেন্ট এরিয়ায় নতুন স্কুল করা হচ্ছে। এ বিষয়ে শিক্ষা অফিসার ও ইউএনওকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান হলে দুটি প্রতিষ্ঠানেরই ক্ষতি হবে।
কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সহকারী পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার বলেন, প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে শেখ হাসিনা টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ নামে শুরু করেছিলাম। কিন্তু কারিগরি বোর্ডের অনুমতির জন্য তাদের পরামর্শে নাম বদলে শেখ হাসিনা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট করা হয়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাঠদানের অনুমতির জন্য আবেদন করা হয়েছে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার নাম ব্যবহারের অনুমতির জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টেও আবেদন করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার বছর ২০১৪ কেন উল্লেখ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় করেছিলাম। সেটা সরকারি হয়ে গেছে। আমার পরিবারের কেউই সেখানে চাকরি পায়নি। তাই ওই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠার বছর ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অধ্যক্ষ হিসেবে আমার জামাতা মো. মনিরুল ইসলাম দায়িত্ব পালন করছেন। সে এখন নাটোর সিটি কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের এমপিওভুক্ত প্রভাষক। তবে এই প্রতিষ্ঠান হয়ে গেলে ওখানে (সিটি কলেজ) ছেড়ে দিয়ে চলে আসবে। তিনি আরও বলেন, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া করে রাখা হয়েছে। এখনো কোন নিয়োগ দেয়া হয়নি।
এ প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এ কে এম রেজাউল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নামে কলেজ খুলে নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়টি জানা ছিলো না। দুই প্রধান শিক্ষকের লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে জানলাম।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রউফ বলেন, পাঠদানের অনুমতি ছাড়া প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ নেই। ভর্তি বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মারিয়াম খাতুন লিখিত অভিযোগ প্রাপ্তির সত্যতা নিশ্চিত করে দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, বিষয়টি তদন্তের জন্য উপজেলা আইসিটি অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।