প্রধান বিচারপতির আত্মীয় আদালতে ১৯ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের অভিভাবক। তার নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টসহ সারা দেশের আদালত পরিচালিত হয়। সেই প্রধান বিচারপতির এক আত্মীয় হাইকোর্টে এসে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। একটি মামলার রায়ের নকল সংগ্রহ করতে দুই আইনজীবীর সহকারীকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েও পাননি রায়ের অনুলিপি। এ ছাড়া মামলার খরচবাবদ আইনজীবীকেও দিতে হয়েছে ১৮ লাখ টাকা। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী সেই ভোগান্তির কথা তুলে ধরেন। 

মামলার জাজমেন্টের কপি তুলতে নিকটাত্মীয়ের হয়রানির কথা তুলে ধরে অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি একটি কেসের ঘটনার কথা আপনাদের বলি, এখানে সুপ্রিম কোর্ট বারের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি আছেন। তারা হয়তো অখুশি হতে পারেন। এখন থেকে সাত-আট বছর আগে আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় সার্ভিস ম্যাটারে 

রিট করার জন্য আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। আমি তাকে অ্যাডভাইস করলাম, বললাম দেখো মামলা-মোকদ্দমা করতে যেও না। মামলা কোরো না। এ মামলাতে তুমি হেরে যাবে। এটা সার্ভিস ম্যাটার। তাকে কেউ হয়তো অ্যাডভাইস করেছে যে, হাইকোর্ট ডিভিশনে যদি রিট পিটিশন করো তাহলে তুমি রিকুইটাল পাবা। কিন্তু এটা হাইকোর্ট ডিভিশনের এখতিয়ারের বিষয় ছিল না।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কিন্তু সে যা-ই হোক, আমি তাকে অ্যাডভাইস করলাম। তারপর আমাকে না জানিয়ে হাইকোর্টে মোকদ্দমাটা করেন। হাইকোর্ট তার পক্ষে রায়ও দেন। রুল অ্যাবসুলুট (যথাযথ ঘোষণা) হয়। অ্যাবসুলুট হওয়ার পর তিনি আর নকল পান না। অনেকদিন ঘুরে ঘুরে নকল যখন পাননি, তখন একপর্যায়ে আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমি তখন দেশের প্রধান বিচারপতি। এর আগে তিনি যে মামলা করেছেন, রুল অ্যাবসুলুট হয়েছে, কিছুই আমাকে বলেননি। কারণ আমি তাকে মামলা করতে বারণ করেছিলাম।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, রিসেন্টলি আমার ব্রাদারদের (সহকর্মী বিচারপতি) কাছে গল্পটা করেছিলাম। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতিটা আপনাদের বোঝানোর জন্য বলছি। আমি তখনও প্রধান বিচারপতি। একদিন সেই আত্মীয় আমার বাসায় গেছেন। আমি কাজ করছিলাম। বাসায় এসে দেখি সেই আত্মীয় কান্নাকাটি শুরু করেছেন। আমি বললাম কান্নাকাটি করো কেন।’ তখন তিনি বললেন, আপনি তো মোকদ্দমা করতে নিষেধ করেছিলেন। আমি মোকদ্দমা করেছিলাম, জিতেছিও। কিন্তু আজ দুই বছর হলো মামলার রায়ের কপি হাতে পাইনি। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ কেসের পারপাসে মোট কত টাকা খরচ করেছো? তিনি তখন বলেন, আমি ল’ইয়ারকে দিয়েছি ১৮ লাখ টাকা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ল’ইয়ার সাহেবের নাম কী? একজনের নাম বললেন। কিন্তু সেই আইনজীবীর নাম আমি এর আগে শুনিনি, দেখিওনি। যারা প্র্যাকটিসিং ল’ইয়ার তাদের সবাইকে তো আমার চেনার কথা। আর ১৮ লাখ টাকা যার ফি তাকে তো চিনবোই। কিন্তু একে আমি চিনতে পারলাম না। ১৮ লাখ টাকা ল’ইয়ার নিয়েছেন। ৪০ হাজার টাকা তার ক্লার্ক নিয়েছেন নকল তোলার জন্য। পরে নকল ওঠানোর জন্য আরেকজন ক্লার্ককে ধরেছেন। তিনি আবার ৮০ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু মামলার নকল পাননি।’

প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে এ সমস্যাটা কিভাবে সমাধান করব? আপনারা বলেন তো দেখি? সমস্যার একটা উদাহরণ দিলাম। এর মধ্যে আশার কথাও আছে আবার হতাশার কথাও আছে। যেগুলো আমাদের উৎসাহিত করে। আবার আলোচনা এরকম করলে কেউ খুশি হবে, কেউ অখুশি হবে। আমি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আমাদের কোনো

একটা কোর্টের ডিসপোজাল মামলার সংখ্যা মাত্র ১৩টি, আবার ওই পিরিয়ডে (সময়কাল) কোনো একটা কোর্ট ডিসপোজাল হয়েছে সাড়ে তিন হাজার। ছয় মাসে সাড়ে তিন হাজার কেস ডিসপোজাল করেছে। যে ১৩টি মামলা ডিসপোজাল করেছে সে বেঞ্চ নিয়ে, আবার যে সাড়ে তিন হাজার কেস ডিসপোজাল করেছে তাকে নিয়েও আমাদের চলতে হবে।’

হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা আমাদের অধস্তন আদালত ভিজিটের কাজে ঝিনাইদহ গিয়েছিলাম, একজন নারী অফিসার নিয়ে এসেছি লিগ্যাল এইড অফিস থেকে। দেখলাম ওদের তিন বছরের এস্টিমেট ধরে কাজ করেছে। ওরা বলল যে, স্যার ওকে নিয়ে গেলেন, সাড়ে ৫০০ মামলা ডিল করেছে। এরকম আছে, এরকমও পেয়েছি, আবার অনেক কম।’

তিনি বলেন, ডাক্তারি পেশা যদি প্রথম মানবসেবা হয় তাহলে আইনজীবীদের মানবসেবা দ্বিতীয় সেবা প্রবেশন হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু সেবা যদি ওই ১৮ লাখ টাকার পর ৪০ হাজার, তারপর ৮০ হাজার, এরপরও জাজমেন্ট নামে না। এটা কোনো সেবা না। এটা নিয়েও চলতে হবে। বারের সভাপতি ও সম্পাদকের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আইনজীবীদের আন্তরিকভাবে চেষ্টা করতে হবে, কেসে (মামলা) মুলতবি না নিয়ে কোর্টকে আপনারা হেল্প করবেন। কোর্টের বিচারকের একার পক্ষে কোনো সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব না, যদি আইনজীবীদের হেল্প না আসে, আইনজীবীর সহকারীর হেল্প না আসে। আইনজীবীর সহকারীরা যদি একটা নকল তুলতে ৮০ হাজার টাকা নিয়ে তারপরও ক্লায়েন্টকে চরকির মতো ঘোরাতে থাকেন, এটা রোধ করবে কে?’ তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির বিষয়ে কোনো ছাড় দেবেন না, সে যত উচ্চপদস্থ অফিসারই হোক, মধ্যম সারির অফিসার হোক, আর যত নিচের কর্মকর্তাই হোক।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030741691589355