প্রধান বিচারপতির আহ্বান যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত

মাছুম বিল্লাহ |

শিশুরা জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে যে ভাষা শোনেন সেই ভাষায়ই স্বপ্ন বোনেন। কিন্তু এই ভাষাটি যদি তিনি শিখতে না পারেন, তবে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তাদের নিজস্ব ভাষায় পড়ার ব্যবস্থা করেছে। এটি অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এখন নির্দিষ্ট কোনো নৃগোষ্ঠীর শিক্ষকরা যদি তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় লেখাতে ও পড়াতে না পারেন সেটি একটি গভীর সমস্যা। এখানে সরকারের পক্ষে হঠাৎ করে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব নয়।

আমাদের দেশে প্রায় ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ বাস করে। তবে সব নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা নেই। সরকার পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় বই তৈরি করেছে, ওই পাঁচটি  ভাষার লোকসংখ্যা বেশি। এটি একটি যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত। তবে, এই মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে। 

বাংলাদেশের শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র জাতীয় প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’য় দেখলাম, গত ৩ মে সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় কুশিয়ারা আন্তর্জাতিক কনভেনশন হলে আয়োজিত এক নাগরিক সংবর্ধনায় দেয়া বক্তৃতায় খাড়িয়া ভাষা ও নাগরী লিপি সংরক্ষণের আহবান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। 

তিনি বলেছেন, আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, কিন্তু অনেকের মাতৃভাষা ভিন্ন। ইতোমধ্যে সরকারের তরফ থেকে খাড়িয়া ভাষা রক্ষায় কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও আরো জোরারোপ করা প্রয়োজন। ভারতের যে সব অঞ্চলে এ ভাষার প্রচলন আছে, সেখানে যোগাযোগ স্থাপন করে খাড়িয়া বর্ণমালা প্রচলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে এ ভাষার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। খাড়িয়া ভাষায় কথা বলা মাত্র দুই জন্য ব্যক্তি অবশিষ্ট আছেন বাংলাদেশে, যারা সম্পর্কে দুই বোন। এদের নাম ক্রিস্টিনা কেরকেট্টা ও ভেরোনিকা কেরকেট্টা। ভারতের রাঁচি থেকে তাদের বাবা মা বাংলাদেশে এসেছিলেন। ভারতের ঝাড়খন্ড এবং উড়িষ্যায় খাড়িয়া ভাষার প্রচলন আছে। বাংলাদেশে সিলেট অঞ্চলের ৩৫টি চা বাগানের গ্রামে তিন থেকে পাঁচ হাজারের মতো খাড়িয়া জনগোষ্ঠী রয়েছে। 

খাড়িয়া সমাজ প্রধান জহরলাল পান্ডে গণমাধ্যমকে জানান, হাতেগোনা দশ-পনেরোজন খাড়িয়া ভাষার গুটিকয়েক শব্দার্থ জানেন এবং কিছু কিছু বোঝেন। তবে অনর্গল কথা বলতে পারেন এ দুইবোন। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো এ ভাষাটি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মৌলভীবাজার জেলা সফরের অংশ হিসেবে মৌলি বাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রে শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা বাগানে বিলুপ্তপ্রায় খাড়িয়া ভাষায় কথা বলা শেষ দুই ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষ্যাৎ শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সরকারকে এ আহ্বান জানা তিনি। আমরা মান্যবর প্রধান বিচারপতির সাথে একমত পোষণ করছি। 

ব্রিটিশ ভাষাবিদ ডেভিঢ ক্রিস্টাল বলেছিলেন, ‘সারা বিশ্বে প্রতি দু’সপ্তাহে একটি করে ভাষার মৃত্যু ঘটে। সারা বিশ্বে এখন মোটামুটি ৬ হাজার ৭০০ এর কাছাকাছি ভাষা রয়েছে। তবে ১০০ বছর পর ভাষার সংখ্যা কমে দাঁড়াবে তিন হাজারে। ক্রিস্টালের মতোই এবার ভাষার মৃত্যু নিয়ে এমন আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন জাতিসংঘের ভাষা বিজ্ঞানীরা। তারা বলেছেন, বিভিন্ন দেশের প্রতি দশটি ভাষার মধ্যে ৪টির অবলুপ্তি নিশ্চিত। মৃত্যপ্রায় চিহ্নিত ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার আর্জি জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংগঠন। সংস্থাটির মহাপরিচালক অড্রে অ্যাজুলাই বিশ্ববাসরি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, প্রতি দুই সপ্তাহে বিশ্বের বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি করে ভাষা। এই ভাষার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি অংশ। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, যখন আপনি কোনো ভাষায় কাউকে কিছু বলেন, তা তার মগজে পৌঁছায়, তিনি তা বুঝতে পারেন। কিন্তু যখন তার নিজের ভাষায় বলেন, তখন তা তার হৃদয়ে পৌঁছায়। অর্থাৎ মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য। এটি আমরা হতে দিতে পারি না। 

প্রধান বিচারপতি খাড়িয়া ভাষা রক্ষায় বিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলেছেন। যথার্থই যৌক্তিক। নিজস্ব ভাষায় পড়ার সুযোগ পেলে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেও শিক্ষার্থীরা। কারণ, তারা এটা খুব ভাল করে আয়ত্ত করতে পারেন। এটি মানব শিশুর একটি সহজাত প্রবৃত্তি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষায় দীর্ঘদিনের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি-এই পাঁচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদানের কার্যক্রম শুরু করে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে। সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নিজেদের ভাষায় পড়াশোনা করবেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা। তৃতীয় শ্রেণি থেকে তাদেরকে বাংলা শেখানো হবে। শিশুদের আনন্দের সঙ্গে পাঠদানের জন্য বাংলা শিখন-শেখানোর উপকরণের আদলে প্রণয়ন করা হয় ৮ ধরনের শিখন-শেখানোর উপকরণ। এই উপকরণগুলোর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে--মাতৃভাষার বই, ছড়ায় ছড়ায় বর্ণ শেখা; বর্ণ লেখার অনুশীলনী খাতা-এসো লিখতে শিখি, বর্ণ ও সংখ্যা ফ্ল্যাশ কার্ড, ফ্লিপ চার্ট, ১০টি গল্প বইয়ের প্যাকেজ, শিক্ষক নির্দেশিকা ইত্যাদি। স্ব স্ব নৃগোষ্ঠীর সাহিত্য, সংষ্কৃতি, ঐতিহ্যের উপাদান নিয়ে ছড়া, কবিতা, গল্প সংযোজন করা হয়েছে উপকরণগুলোতে।

বইয়ে ছবির মাধ্যমে বর্ণমালা শেখানো, গণনা শেখার ধারণা, সাধারণ জ্ঞান (চিহ্নের মাধ্যমে হাসাপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চেনানো), পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি যুক্ত করা হয়েছে। উপকরণগুলোর অধিকাংশই নিজ নিজ মাতৃভাষায় রচিত। শুধু শিক্ষক সহায়িকার নির্দেশনাগুলোতে বাংলা ব্যবহার করা হয়েছে। উপকরণগুলোর বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বিষয়বস্ত হুবহু রেখে বাংলার সাধারণ বই থেকে অনুবাদ করা হয়েছে--যেমন বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত লেখা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প ও নিবন্ধ, হযরত মুহম্মদ (স.)-এর জীবনী ইত্যাদি। ১০টি গল্পের বইয়ের প্যাকেজের মধ্যে চারটি বই বাংলা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে, বাকি ছয়টি যার যার সমাজ জীবনে প্রচলিত শিক্ষামূলক গল্প থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এটিকে একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত বলা যায়।

আমাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর অনেকের নিজস্ব ভাষার লিপি ও বর্ণমালা রয়েছে, তবে শিক্ষা চর্চার সুযোগ না থাকায় এসব ভাষার বেশিরভাগই হারিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার বাইরে সবচেয়ে বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস সিলেট অঞ্চলে। এই বিভাগে প্রায় ৩৭টি ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠী রয়েছে। এর মধ্যে চা বাগানেই রয়েছে ২৫-২৬টি জনগোষ্ঠী। তবে সিলেটের ৩৭ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখন পর্যন্ত দু-তিনটি ছাড়া আর কারোরই সরকারিভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ মেলেনি। মণিপুরী ল্যাংগুয়েজ সেন্টার নামে কমলগঞ্জে মণিপুরী ভাষা শিক্ষার তিনটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ‘এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো)’। 

কিন্তু মণিপুরী ছাড়া এখানকার অন্য অনেক নৃগোষ্ঠীর ভাষার বর্ণমালাই নেই। শিক্ষকের অভাব তো আছেই। এই বাস্তব অবস্তায় প্রধান বিচারপতির আহবান যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। তবে আমরা মনে করি, শুধু খাড়িয়া নয়, প্রত্যেক ভাষারই চর্চা চালু থাকা উচিত। 

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0140380859375