সভাপতির রোষানলপ্রধান শিক্ষক এখন দিনমজুর

পাবনা প্রতিনিধি |

পাবনার বেড়া পৌর এলাকার সানিলা মহল্লার বাসিন্দা মো. নায়েব আলী। বছর দুয়েক আগেও পেশায় ছিলেন বেড়া বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কিন্তু বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের (ম্যানেজিং কমিটি) সভাপতির রোষানলে পড়ে সংসার চালাতে এখন তিনি দিনমজুর। স্ত্রীসহ তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে জীবিকা নির্বাহে শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের পড়ানো ছেড়ে এখন তার দিন কাটে পরের জমিতে দিনমজুরির কাজে।

বেড়া বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়য়ের একাধিক শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নায়েব আলী বেড়া হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে শুরু করেন কর্মজীবন। পরে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন বেড়া বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। ওই সময় বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য শামসুল হক টুকুর ভাই ও বেড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল বাতেন। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে বাতেন ও টুকু পরিবারের সঙ্গে প্রধান শিক্ষক নায়েব আলীর চাচা উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ দুলালের বিরোধ শুরু হয়। এতে আবদুল বাতেনের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন নায়েব আলী।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘অ্যাডহক কমিটির সভাপতি আবদুল বাতেনের অনুসারী কিছু অসৎ শিক্ষক ও কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ের পুকুর ও জায়গা জবর দখল করে রেখেছিলেন। এরই মধ্যে সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে অফিস সহকারী পদে স্ত্রীর চাকরি দাবি করেন আবদুল বাতেনের এক সহযোগী। এসব অনৈতিক আবদারের বিরোধিতা করায় একপর্যায়ে আবদুল বাতেনের চক্ষুশূলে পরিণত হই। পাশাপাশি চাচা আবদুর রশিদ দুলালের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের কারণে তারা আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে ওঠেন।’

অনিয়ম-দুর্নীতিতে বাধা দেওয়ায় একপর্যায়ে আবদুল বাতেন ও তার অনুসারীরা তাকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করেন দাবি করে নায়েব আলী বলেন, ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে আমার বিরুদ্ধে দরপত্র দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎসহ সাতটি অনিয়মের অভিযোগ তোলেন তারা। এ অভিযোগ খতিয়ে দেখতে উপজেলা কৃষি অফিসারকে প্রধান ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার খবিরউদ্দিনকে সদস্য করে তদন্ত কমিটি গঠন হলে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আমাকে ৬০ দিনের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর আমার অবর্তমানে সহকারী প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়ার কথা থাকলেও তাকে না দিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে তার আজ্ঞাবহ জুনিয়র শিক্ষক শফিকুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেন সভাপতি।’

নায়েব আলী আরও বলেন, ‘অভিযোগ তদন্তে কমিটি কাজ শুরু করলে ম্যানেজিং কমিটি ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের অসহযোগিতায় এখন পর্যন্ত তদন্তকাজ শেষ হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, সাময়িক বরখাস্ত থাকাকালে বেতনভাতা পাওয়ার কথা থাকলেও গত দেড় বছরে আমাকে একটি টাকাও বেতন দেওয়া হয়নি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খবিরউদ্দিন বলেন, ‘ওই বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তদন্ত কমিটিকে কোনো নথিপত্র দেখাননি। ফলে একাধিকবার চেষ্টা করেও তদন্ত সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।’

এদিকে গত বছর ২ মার্চ সংসদ সদস্য শামসুল হক টুকুর ছেলে আসিফ শামস রঞ্জনকে সভাপতি করে ছয় মাসের জন্য বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের নতুন অ্যাডহক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে এ বছরের জানুয়ারিতে নিজেকে সভাপতি করে দুই বছর মেয়াদের ১০ সদস্যের ম্যানেজিং কমিটির অনুমোদন করিয়ে নেন আসিফ শামস রঞ্জন।

অন্যদিকে বেতনভাতা না পেয়ে জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেন ভুক্তভোগী প্রধান শিক্ষক নায়েব আলী। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মহা. জিয়াউল হক স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে সাময়িক বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক নায়েব আলীকে কেন বেতনভাতা দেওয়া হচ্ছে না জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়। এ ছাড়া একই বছরের ৩ অক্টোবর সমুদয় বেতনভাতা প্রদানের নির্দেশনা দিয়ে ম্যানেজিং কমিটিকে চিঠি দেয় শিক্ষা বোর্ড। কিন্তু এরপরও নায়েব আলীকে বেতনভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেনি ম্যানেজিং কমিটি। দিনের পর দিন বেতন না পেয়ে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন প্রধান শিক্ষক নায়েব আলী। জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে তাই করছেন দিনমজুরি।

ভুক্তভোগী বরখাস্তকৃত প্রধান শিক্ষক নায়েব আলী বলেন, ‘যেসব অভিযোগ এনে আমাকে হেনস্তা করা হচ্ছে তার কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। যার কারণে তারা (ম্যানেজিং কমিটি) তদন্তও করতে দেননি। সাময়িক বরখাস্তের ৬০ দিন পেরিয়ে গেলেও তারা আমাকে বেতনভাতা তো দূরের কথা, আমাকে স্কুলের আশপাশেও যেতে দেন না সভাপতির অনুসারীরা। হুমকি দিয়ে ভয়ভীতি দেখান।’

নায়েব আলীকে সাময়িক বরখাস্তের পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়ার কথা ছিল সহকারী প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলামের। এ প্রসঙ্গে তিনি  বলেন, ‘নিয়ম থাকলেও আমি এ দায়িত্ব পাইনি। কেন পাইনি এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না।’

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক জানান, পছন্দের ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিতে, প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে সহকারী প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম আগ্রহী ননÑ এমন লিখিত মুচলেকা দিতে বাধ্য করা হয়। এই শিক্ষকরা বলেন, সভাপতির অনুসারীরা বিদ্যালয়কে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করেছে। এসবের প্রতিবাদ করলে চাকরিচ্যুত করার ভয় দেখানো হয়।

এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের মোবাইল ফোনে কল করে সাংবাদিক পরিচয় দিলে কথা বলবেন না জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে আবারও কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। আর বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সাবেক সভাপতি আবদুল বাতেনের মোবাইল ফোনে কল করে তা বন্ধ পাওয়া গেছে।

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির বর্তমান সভাপতি আসিফ রঞ্জন শামসের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ না করে কেটে দেন। পরে এ প্রতিবেদক নিজের পরিচয় জানিয়ে এ বিষয়ে তার বক্তব্যের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া মেলেনি।

সার্বিক বিষয়ে পাবনা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রোস্তম আলী হেলালী বলেন, ‘আমি এখানে নতুন যোগদান করায় বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। তবে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সংযুক্ত ইবতেদায়ি শিক্ষকদের কপাল খুলছে - dainik shiksha সংযুক্ত ইবতেদায়ি শিক্ষকদের কপাল খুলছে মধ্যরাতে ববি-বিএম কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘ*র্ষ, আহত ২৫ - dainik shiksha মধ্যরাতে ববি-বিএম কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘ*র্ষ, আহত ২৫ সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিন, সম্পাদকদের ড. ইউনূস - dainik shiksha সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিন, সম্পাদকদের ড. ইউনূস এইচএসসি ফল তৈরি: পরীক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছে বোর্ড - dainik shiksha এইচএসসি ফল তৈরি: পরীক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছে বোর্ড শিক্ষায় বন্যার ক্ষত, চিন্তিত অভিভাবকরা - dainik shiksha শিক্ষায় বন্যার ক্ষত, চিন্তিত অভিভাবকরা শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য ও হেনস্তা নয়: শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য ও হেনস্তা নয়: শিক্ষা উপদেষ্টা স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের আগস্ট মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের আগস্ট মাসের এমপিওর চেক ছাড় এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডিজি হলেন - dainik shiksha এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডিজি হলেন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027999877929688