প্রধান শিক্ষক নেই শেরপুরের ৩৭২ বিদ্যালয়ে, ৯৪ মামলা

শেরপুর প্রতিনিধি |

শেরপুরের পাঁচ উপজেলার কয়েকশ প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পদোন্নতি বন্ধ থাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয়করণ হওয়া ৯৪টি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা নিজেদের প্রধান শিক্ষক দাবি করে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসায় নিয়োগ জটিলতা বেড়েছে। প্রধান শিক্ষক পদে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সহকারী শিক্ষকরা। 

সরকারি নীতিমালা অনুসারে একজন প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের যাবতীয় রেকর্ড, রেজিস্টার ও ফাইল সংরক্ষণ করবেন। বিদ্যালয় গমনোপযোগী শিশুদের বার্ষিক জরিপের কাজ শিক্ষকমণ্ডলী ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সহযোগিতায় সম্পন্ন করবেন এবং জরিপের স্থায়ী রেজিস্টার সংরক্ষণ করবেন। অভিভাবকদের তাদের সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করবেন। বিদ্যালয়ে শিশুদের দৈনিক ও নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করবেন। বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে সেই আলোকে সাপ্তাহিক রুটিন প্রণয়ন করবেন। বিদ্যালয়ের পরিবেশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতসহ ১৯ ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয় তাদের। এ ছাড়াও একাডেমিক, তত্ত্বাবধানিক, আর্থিক, ক্লাস্টার ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। এত সব কাজ করে কোনোভাবেই একজন শিক্ষক পাঠদানে মনোনিবেশ করতে পারেন না। এ কারণে শেরপুরের কয়েকশ বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে পঠনপাঠন ব্যাহত হচ্ছে। 

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, শেরপুরের পাঁচ উপজেলায় ৩৭২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ ফাঁকা। এর মধ্যে শূন্যপদ সবচেয়ে বেশি শ্রীবরদী উপজেলায়। এ উপজেলায় ১০৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ ফাঁকা। এ উপজেলায় ৩০টি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা নিজেদের প্রধান শিক্ষক দাবি করে উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ।

ঝিনাইগাতি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নূরননবী জানান, তাঁর উপজেলায় ৫৯টি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন ১২ শিক্ষক। উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলা চলাকালে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। তাই নিয়োগ হচ্ছে না।

নালিতাবাড়ী উপজেলায় প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদ ৭৩টি। নিজেদের সহকারী শিক্ষক হিসেবে মানতে নারাজ ১৩টি রেজিস্টার্ড বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষকরা। তারা উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছেন। ফলে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ। 

উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রশিদা বেগম বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক না থাকলে বিদ্যালয়ের লিডারশিপ পাওয়ার থাকে না। সহকারী শিক্ষক যিনি দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁর কথা কেউ শুনতে চান না। ক্লাস ঠিকমতো হয় না। ১২টার মিটিং এক-দেড় ঘণ্টা পরে শুরু হয়। সব মিলিয়ে খুব বিপদে আছি।’

নকলা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জিয়াউল হকের ভাষ্য, তাঁর উপজেলায় ৬৩ বিদ্যালয় বছরের পর বছর প্রধান শিক্ষক ছাড়াই চলছে। রেজিস্টার্ড বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষকরা ২০টি মামলা করেছেন।

শ্রীবরদী উপজেলার সাতানী মথুরাদী দক্ষিণপাড়া বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষকের পদ ফাঁকা। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকও মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। সহকারী শিক্ষক নার্গিস আক্তারের ভাষ্য, তিন শিক্ষকের মধ্যে একজনকে দাপ্তরিক কাজে সময় দিতে হয়। দুই শিক্ষক পাঠদানের দায়িত্বে আছেন। এ কারণে মানসম্মত পাঠদান অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

কথা হয় আবুয়ারপাড়া দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাহমুদুল আলমের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর বিদ্যালয়ে ছয় শিক্ষকের বিপরীতে আছেন চারজন। তিনি দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। তিন শিক্ষক পঠনপাঠন চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

শ্রীবরদী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলামের দাবি– মৃত্যু, অবসরজনিত কারণ এবং পদোন্নতি বন্ধ থাকায় প্রধান শিক্ষকের এত পদে শূন্যতা তৈরি হয়েছে।

শেরপুর সদর উপজেলার ৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই প্রধান শিক্ষক। পৌর শহরের খরমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূরুন্নাহার ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে অবসরে যান। এর পর থেকে সহকারী শিক্ষক শামসুন্নাহার মলি দায়িত্বে আছেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মলির ভাষ্য, প্রতিষ্ঠান প্রধান যেভাবে বিদ্যালয় চালাবেন, একজন সহকারীর পক্ষে সেভাবে পরিচালনা করা সম্ভব না। কষ্ট হলেও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারণে চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি।

সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আকরাম হোসেন বলেন, ‘যোগ্যতা নেই, অথচ উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন রেজিস্টার্ড থেকে জাতীয়করণ হওয়া ১৯ জন সহকারী শিক্ষক। স্থগিতাদেশ থাকায় ওই পদগুলোতে নিয়োগ দিতে পারছি না। বাকি পদগুলো পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’

শেরপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিও) মো. ওবায়দুল্লাহ জানান, উপজেলাভিত্তিক পদোন্নতির তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠানো হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন সভাপতির একক স্বাক্ষরে - dainik shiksha অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন সভাপতির একক স্বাক্ষরে দুই শব্দে অধ্যক্ষের পদত্যাগ! - dainik shiksha দুই শব্দে অধ্যক্ষের পদত্যাগ! বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে পাকিস্তান - dainik shiksha বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে পাকিস্তান বিএনপি নির্বাচিত হলে গুম প্রতিরোধে আইন করব: তারেক - dainik shiksha বিএনপি নির্বাচিত হলে গুম প্রতিরোধে আইন করব: তারেক ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ইসহাক আলীর মৃত্যু শ্বাসরোধে: মেঘালয় পুলিশ - dainik shiksha ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ইসহাক আলীর মৃত্যু শ্বাসরোধে: মেঘালয় পুলিশ ঢাবিতে যোগ দিলেন চাকরিচ্যুত অধ্যাপক ড. সাইফুল - dainik shiksha ঢাবিতে যোগ দিলেন চাকরিচ্যুত অধ্যাপক ড. সাইফুল কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025830268859863