প্রবীণত্ব যেন অভিশাপ না হয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রবীণদের বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার নানা অনুষঙ্গের কণা প্রায় প্রতিবছর চর্বিতচর্বণ করতে গিয়ে কখন যেন নিজেই প্রবীণত্ব অতিক্রম করে চলেছি। এখন তরিতে পা রেখে পারের পানে যাওয়ার প্রহর গোনা। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির শরৎ-শোভার মনোরম দৃশ্যের অবতারণা করতে গিয়ে প্রবীণত্বের একটি পেলব চিত্রও এঁকেছিলেন : ‘যৌবনের শেষে শুভ্র শরৎকালের ন্যায় একটি গভীর প্রশান্ত প্রগাঢ় সুন্দর বয়স আসে, যখন জীবনের ফল ফলিবার এবং শস্য পাকিবার সময়।’ এই প্রশস্ত প্রগাঢ় সুন্দরের মধ্যে যে অভিশপ্ত যন্ত্রণা ওত পেতে আছে, তা জানিয়ে দিতে তিনি ভোলেননি। ‘যৌবনের সেই স্নিগ্ধ সায়াহ্নে জীবনের সেই শান্তিপর্বেও যাহাকে নূতন সঞ্চয়, নূতন পরিচয়, নূতন বন্ধনের বৃথা আশ্বাসে নূতন চেষ্টায় ধাবিত হইতে হয়—তখনও যাহার বিশ্রামের জন্য শয্যা রচিত হয় নাই, যাহার গ্রহণ প্রত্যাবর্তনের জন্য সন্ধ্যাদীপ প্রজ্বলিত হয় নাই—সংসারে তাহার মতো শোচনীয় আর কেহ নাই।’ রবীন্দ্রনাথের এই অভিব্যক্তি মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ‘বিচারক’ গল্পে লেখা। মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, তরুণ রবীন্দ্রনাথের এই জীবন বীক্ষণের আজও তেমন হেরফের হয়নি। আমরা তাঁর বক্তব্যের প্রথমাংশকে স্বাগত জানাতে থাকব; তবে অপরাংশের অভিশাপ থেকে কিভাবে মুক্ত থাকা যায়, তা অনুসন্ধানের জন্য এই ক্ষুদ্র আয়োজন।

মানুষের বয়স বাড়ে, তার সঙ্গে চেতনায় এগিয়ে চলে। তখন মনে হয়, বেঁচে থাকা মৃত্যু অপেক্ষা যন্ত্রণার। একে দুঃস্বপ্ন ভাবাই শ্রেয়। কারণ বেঁচে থাকার আরজি মানুষ ছাড়াও অন্য সৃষ্টিজগতে কম নয়। প্রকৃতি তার সৃষ্টি সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার বহুবিধ কৌশল অবলম্বনের সুযোগ করে দিয়েছে। সভ্য আর ধীমান বলে কথিত মানুষ তা ধ্বংস করতে মত্ত। এই মত্ততার ভয়াবহ পরিণতি জেনেও চিরকালের স্বার্থান্ধরা সেখান থেকে শিক্ষা নেয় না।

উমাইয়া যুগের জনৈক কবি বার্ধক্যের সূচনাকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘লাম্মা রায়াইতুস সায়বা লাহা বায়াদুহু, ফাকুলতু লিস সায়বে মারহাবা।’ যার অর্থ : সীমন্তে কেশবীথির মাঝে পাকা চুল দেখে তাকে অভিনন্দন জানাই। (বেঁচে থাকার অমরতার অনুভবে কি!) ধর্মে দীর্ঘ আয়ুর জন্য প্রার্থনার ভাষা আছে। অনেক মনীষী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ আয়ুকে অভিশাপ ভেবেছেন, রবীন্দ্রনাথও তা ভাবতে বাধ্য হয়েছেন : ‘দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ।’ এখনো চরম ভুক্তভোগীরা সে ভাবনার অনুকূলে এবং কঠিন বাস্তবতার কথা ভেবে আতঙ্কিত।

কারণ সন্তান-সন্ততি জনক-জননীর প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না। এর বিবিধ কারণ আমরা বিশ্লেষণে যাব না। তবে প্রবীণত্বকে কিভাবে সহনীয় করা যায়, সেই কঠিন বিষয়টি খুঁজে দেখার চেষ্টা করে দেখতে পারি। আর এ কর্মযজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে কঠিন। সমষ্টির পক্ষে সহজ। তাই সমষ্টি তথা রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে জগতের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির জন্য। ভাবতে শেখা উচিত আজকের তরুণ, আগামী দিনের প্রবীণ।

আমাদের শিক্ষায় নানা মতবাদের বিষয় চাপিয়ে না দিয়ে মানুষের জন্য মানুষের করণীয় সম্পর্কে ধারণা দেওয়া উচিত। শোনা যায়, জার্মানিতে অন্তিমযাত্রীর শিয়রে থেকে তরুণরা বাস্তব জ্ঞান লাভ করে এবং শেষ জীবন যেন ভয়ংকররূপে প্রতিভাত না হয়, তার পাথেয় সংগ্রহ করে। স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজনে পরিমিত সম্পদ বৃদ্ধির কৌশল অবশ্যই জানতে হবে, তার সঙ্গে জীবনের শেষ পর্যায়টি যেন সুখকর হয়, সে দৃষ্টিও প্রসারিত করা উচিত।

দেশে বড় বড় শহরে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে উঠছে। মায়েরা সংসারের কাজ সামলে কর্মস্থলের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যথাযথ সন্তান লালনের সময় বের করতে পারেন না। সন্তানের প্রতি নিবিড় দায়িত্ববোধের পরিবর্তে দুরাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সদা ব্যগ্র। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে তাতে কিছুটা দায়সারা হয়। তবে আত্মপ্রসাদ বিঘ্নিত হয়।

আমরা নৈরাশ্যকে প্রশ্রয় দেব না। দিবাযত্ন কেন্দ্রে সন্তান লালনের প্রক্রিয়ায় আমরা আত্মপ্রসাদ বঞ্চিত হলেও একদিন তারা নিজের পায়ে দাঁড়াবে সেই ভরসা রাখি, যদিও তা অনেকটা রোবটিক। একই পথরেখায় সামর্থ্যবানরা যদি প্রবীণদের জন্য পরিচর্যাকেন্দ্র খোলেন, তবে অসহায় বৃদ্ধরা হা-হুতাশ করে শূন্যে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলবেন না। সামর্থ্যবানদের পক্ষে এ প্রক্রিয়া অবলম্বন কষ্ট কল্পনা নয়; কিন্তু ছিন্নমূল প্রবীণ, যাঁদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই, তাঁরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন! এখানেই কল্যাণকামী সরকারের পূর্ণ দায়িত্ব এসে যায়। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টির অগ্রাধিকার প্রদান জরুরি। দুঃখের বিষয়, এ কাজে যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হবে, তাঁরা বোধ করি অনন্ত যৌবন ধারণ করবেন। তাই ওমর খৈয়ামের কবিতার বাইরের অর্থ শিরোধার্য ভেবে ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও’ অপকর্মে লিপ্ত হবেন। বিষয়টি বিবেকবান মানুষ খতিয়ে দেখে প্রবীণদের কল্যাণে প্রবৃত্ত হলে অসহায় ব্যক্তিরা জীবনের শেষ কয়টা দিন দুর্ভাবনাহীন কাটাতে পারবেন এবং প্রবীণত্বকে অভিশাপ ভাববেন না।

গোলাম কবির : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025899410247803