প্রভাষকের ভাতিজার বিয়েতে অধ্যক্ষের ‘দরদি’ আদেশ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

এক প্রভাষকের ভাতিজার বৌভাতের অনুষ্ঠানে কলেজের সব শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক উপস্থিতি থাকতে হবে। একই সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হবে চাঁদা। বিজ্ঞপ্তি আকারে অফিস আদেশের মাধ্যমে এমন নির্দেশনা দিয়েছেন কলেজটির অধ্যক্ষ। অস্বাভাবিক এমন ঘটনা ঘটেছে রাজবাড়ীর পাংশা সরকারি কলেজে।

জানা গেছে, পাংশা সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক এ কে এম শরিফুল মোর্শেদ বর্তমানে ছুটি নিয়ে আমেরিকায় অবস্থান করছেন। তবে তার ভাতিজার বিয়ের অনুষ্ঠানে সব শিক্ষকের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করেছেন অধ্যাপক ক্যাপ্টেন মো. ইয়ামিন আলী। সেইসঙ্গে উপহারের জন্য আবশ্যিকভাবে চাঁদাও দিতে হবে। প্রভাষক শরিফুল মোর্শেদ অতিঘনিষ্ঠ হওয়ায় তার ভাতিজার বিয়ে নিয়ে অধ্যক্ষের এই অতিউৎসাহী বলে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা জানিয়েছেন।

গত ২৫ অক্টোবর অধ্যক্ষ অধ্যাপক ক্যাপ্টেন মো. ইয়ামিন আলী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘এতদ্বারা পাংশা সরকারি কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জানানো যাচ্ছে যে, অত্র কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও শিক্ষক পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এ কে এম শরিফুল মোর্শেদ স্যারের ভাতিজার বিবাহের বৌভাত আগামী ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। বৌভাতের অনুষ্ঠানে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।’

গত ২০ অক্টোবরের মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছুটি থাকায় বিজ্ঞপ্তিটি নোটিশ বোর্ডে না দিয়ে কলেজের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপে দাওয়াত কার্ড সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে চাঁদার কথা উল্লেখ করা না হলেও বৌভাতের অনুষ্ঠানের জন্য শিক্ষকদের জন্য ৮০০ টাকা এবং কর্মচারীদের জন্য ৩০০ টাকা করে

চাঁদা ধার্য করা হয়েছে বলে জানা গেছে। নিয়মনীতি তো দূরের কথা অতীতে এ ধরনের নজির না থাকায় বিষয়টি নিয়ে পাংশা সরকারি কলেজের শিক্ষকরা হতবাক হয়েছেন।

কলেজটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং রসায়ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক নুশরাত হাছনীন  ‘এমন একটি বিজ্ঞপ্তি আমাদের মেসেঞ্জার গ্রুপে দেওয়া হয়েছে। সেখানে কলেজের একজন শিক্ষকের ভাতিজার বিয়ের অনুষ্ঠানে বাধ্যতামূলক উপস্থিত থাকা এবং চাঁদা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাধ্যতামূলক উপস্থিত থাকার পাশাপাশি শিক্ষকদের ৮০০ টাকা এবং কর্মচারীদের ৩০০ টাকা করে চাঁদা দেওয়াটাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।’

বিজ্ঞপ্তিটিকে অদ্ভুত আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘এমন বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারও ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য কেন এমন বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো সে বিষয়ে অধ্যক্ষ স্যারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দেননি।’

জানা গেছে, এ বিষয়ে গত ২০ অক্টোবর একটি সভা আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু ওইদিন ছুটি থাকায় অনেকে উপস্থিত থাকতে পারেননি। যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে অনেক শিক্ষক আপত্তিও জানিয়েছিলেন; কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। শিক্ষকদের মতামতের তোয়াক্কা না করে অধ্যক্ষ নিজেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সাধারণত জাতীয় বিশেষ দিবস ছাড়া এ ধরনের ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা যায় না। এ বিষয়ে কলেজটির শিক্ষকরা নিন্দা জানিয়ে বলছেন, এটা বিধিবহির্ভূত। এমন সিদ্ধান্ত অধ্যক্ষের স্বেচ্ছাচারিতার উদাহরণ।

জানা গেছে, পাংশা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আগে থেকেই রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কিছু ঘনিষ্ঠ শিক্ষক ছাড়া কোনো বিষয়েই তিনি কারও মতামত গ্রহণ করেন না তিনি।

অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

জানা গেছে, ওই এলাকার মধ্যে পাংশা সরকারি কলেজে সর্বোচ্চ ভর্তি ফি আদায় করা হয়। ভর্তি ফরম জমা দেওয়ার সময় রসিদ ছাড়া অতিরিক্ত ২০০ টাকা আদায় করা হয়।

এ বিষয়ে কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, আশপাশের কলেজ থেকে এই কলেজে ভর্তি ফি বেশি নেওয়া হয়। এমনকি ফরম জমা দিতে গেলে কোনো রসিদ ছাড়াই আবার ২০০ টাকা করে নেওয়া হয়। অতিরিক্ত টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে এক শিক্ষককে অপমান অপদস্ত করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে কলেজের শিক্ষক ডরমিটরিতে শিক্ষকদের থাকার কথা। কিন্তু শিক্ষকদের উচ্ছেদ করে ২টি পাকা এবং চারটি টিনশেডের রুমের ডরমিটরিটি দখলে নিয়েছেন অধ্যক্ষ ইয়ামিন আলী। সেখানে তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করেন।

ডরমিটরি থেকে উচ্ছেদ হওয়া সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আব্দুর রউফ বলেন, ‘ডরমিটরিতে অধ্যক্ষ পরিবার নিয়ে থাকবেন বলে আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকরা একটা নির্দিষ্ট ভাড়া দিয়ে সেখানে থাকতেন; কিন্তু বর্তমান অধ্যক্ষ কোনো ভাড়া ছাড়াই সেখানে থাকছেন।’

জানা গেছে, কলেজের টাকায় কেনা টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন আসবাব অধ্যক্ষ নিজের বাসায় ব্যবহার করেন। তার বাসার গৃহকর্মীর মাসিক বেতনও কলেজের ফান্ড থেকে নেওয়া হয়। এমনকি কলেজের মালিকানাধীন পুকুরের মাছ অধ্যক্ষ নিজের পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের বাসায় পাঠান।

কলেজের ক্রয় কমিটির আহ্বায়ক জানান, ‘অধ্যক্ষের নির্দেশে কলেজের তহবিল থেকে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে একটা টিভি কেনা হয়েছে। কিন্তু সেটি এখন কোথায় ব্যবহার হচ্ছে জানা নেই। তবে শুনেছি, কলেজের টাকায় কেনা টিভি অধ্যক্ষ তার বাসায় ব্যবহার করছেন।’

এ ছাড়া, কাজ না করেও ভুয়া বিল-ভাউচার দিয়ে কলেজের টাকা উঠিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষকের বিরুদ্ধে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর কলেজের রাসায়নিক দ্রব্য এবং বিভিন্ন অবকাঠামো মেরামত খাতে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা দেওয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু কোনো কাজ করা না হলেও বিল-ভাওচার দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করেছেন অধ্যক্ষ ইয়ামীন আলী।

এখানেই শেষ নয়, তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে বিধিবহির্ভূতভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর নিয়ে। নিয়ম অনুযায়ী অধ্যক্ষ কলেজের বাইরে থাকলে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে দায়িত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি এই নিয়ম না মেনে অনিয়মিত শিক্ষকদের দায়িত্ব দেন, যা সম্পূর্ণভাবে বিধিবহির্ভূত। বেশিরভাগ সময় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক এ কে এম শরিফুল মোর্শেদ এবং বাংলা বিভাগের প্রভাষক শিব শংকর চক্রবর্তীকে রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে কলেজটির সহকারী অধ্যাপক নুশরাত হাছনীন বলেন, ‘অধ্যক্ষ স্যারের অনুপস্থিতিতে বিধি অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সহকারী অধ্যাপকের দায়িত্ব দেওয়ার কথা। সেটা না হলেও ক্যাডারভুক্ত প্রভাষকদের দেওয়ার কথা; কিন্তু সেটা না করে তিনি ওই দুজনকে দায়িত্ব দেন, যেটা সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. ইয়ামিন আলী বলেন, ‘প্রভাষকের ভাতিজার বিয়ের অনুষ্ঠানে বাধ্যতামূলক উপস্থিতির বিষয়ে মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো অফিস আদেশ দেওয়া হয়নি। বিজ্ঞপ্তি আকারে জানানো হয়েছে।’

তবে ওই বিজ্ঞপ্তিতে স্মারক নম্বর এবং অফিস আদেশ উল্লেখ করা হয়েছে।

কলেজের সম্পদ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারসহ অন্যান্য অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্য চাওয়া হলে ব্যস্ততার অজুহাতে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে ফোন কেটে দেন।

পাংশা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের এসব কর্মকাণ্ডে বিব্রত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারাও। সমিতির কোষাধ্যক্ষ এস এম কামাল আহমদ বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে বিধিবহির্ভূতভাবে দায়িত্ব অর্পণ এবং বিসিএস ক্যাডারের শিক্ষকদের অসম্মান করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্নভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু তিনি কিছুই শোনেন না। তিনি এমন কাজ করে গোটা শিক্ষা ক্যাডারকে লজ্জার মুখে ফেলছেন।’

সূত্র : কালবেলা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0058560371398926