বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত হতে চান অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যে একীভূত হয়েছে সচিবালয় ও ইকোনমিক ক্যাডার। সম্প্রতি প্রশাসন ক্যাডারে আসার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে আরও তিনটি ক্যাডার। এরা হলো ট্রেড, তথ্য ও সমবায়। আবেদনগুলো পর্যালোচনাধীন। মূলত নতুন পদ সৃষ্টি না হওয়া, বৈষম্য ও পদোন্নতি বঞ্চনার কারণে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তারা প্রশাসনে একীভূত হতে চান বলে জানা গেছে।
হবিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে পদের চেয়ে বেশি কর্মকর্তা কাজ করছেন। পদ না থাকার পরও কর্মকর্তাদের নিয়মিত পদোন্নতি হচ্ছে। নিজস্ব ক্যাডারের পদ ছাড়াও অন্য ক্যাডারের পদে গিয়ে কাজ করছেন তারা। কিন্তু বিসিএসের অন্যান্য ক্যাডারের চিত্র উল্টো। তথ্য, খাদ্য, পরিসংখ্যান, ট্রেড, সমবায়সহ অন্যান্য ক্যাডারে নতুন পদ সৃষ্টি ও পদোন্নতির প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বছরের পর বছর ঝুলে আছে। ফলে যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন। এদিকে শিক্ষা, তথ্য ও ট্রেড ক্যাডারে পদ খালি থাকা সত্ত্বেও সঠিক সময়ে পদোন্নতি হচ্ছে না। ট্রেডসহ কোনো কোনো ক্যাডারে নিয়মিত নিয়োগই হয় না। প্রশাসন ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারে পদোন্নতির সুযোগ সীমিত। ফলে অন্যান্য ক্যাডারে দক্ষতা বৃদ্ধিসহ ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়েও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে দিন দিন কমছে অন্যান্য ক্যাডারের পদসংখ্যা। সীমিত হচ্ছে কার্যপরিধি। প্রশাসন ছাড়া অন্য ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী যথাযথভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অবদানও রাখতে পারছেন না। নানা বঞ্চনার কারণে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত। ফলে বিসিএস সচিবালয় ও ইকোনমিক ক্যাডারের মতো এবার তথ্য, ট্রেড ও সমবায় ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হতে সরকারের কাছে আবেদন করেছে। সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি বিসিএস ইকোনমিক ক্যাডারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী একটি ক্যাডার বিসিএস প্রশাসনের সঙ্গে একীভূত হওয়ায় কম সংখ্যক পদের ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত ২৫ ক্যাডারের মধ্যে তিন ক্যাডারের নেতারা সম্প্রতি প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হওয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। এই ক্যাডারগুলো হলো তথ্য, ট্রেড ও সমবায়।
জানা যায়, বিভিন্ন ক্যাডারের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন নীতির কারণে দক্ষ পেশাজীবী গড়ে তোলার উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন। যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী দেশের জন্য পুরোপুরি অবদান রাখতে পারছেন না ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা। কম সংখ্যক পদের ক্যাডার কর্মকর্তারা মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। ফলে বিসিএস ট্রেড ক্যাডারের ৩২টি পদে ২৪ জন কর্মকর্তা, সমবায় ক্যাডারের ১০০ কর্মকর্তা, তথ্য সাধারণ ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান এবং বার্তা বিভাগের ৩১৬ জন, খাদ্য ক্যাডারের ১৫০ জন কর্মকর্তাও প্রশাসনে একীভূত হতে চান।\হবাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়ে কয়েকটি ক্যাডার প্রস্তাব দিয়েছে। আইন অনুযায়ী সাধারণ ক্যাডারের কর্মকর্তারা উভয়ে একমত হলে যে কোনো সময় তারা একীভূত হতে পারে। তবে টেকনিক্যাল ক্যাডারের কর্মকর্তারা সাধারণ ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হতে পারবেন না। তিনি বলেন, একীভূত হওয়ার সাম্প্রতিক প্রস্তাবগুলো অ্যাসোসিয়েশনের পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করা হবে। অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা বৈঠকে হয়তো আপত্তি জানাবে না। আবার কেউ জানাতেও পারেন। তবে একীভূত হওয়ার বিষয়টি আপত্তি বা অনাপত্তির ওপর নির্ভর করে না। এটি পুরোপুরি সরকারপ্রধানের ওপর নির্ভর করে। সরকারপ্রধান অনুমোদন দিলে একীভূত হতে কোনো সমস্যা নেই। যে কোনো ক্যাডার প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হতে পারবে।
বিসিএস তথ্য সাধারণ বেতার কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার (সচিব) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, একীভূত হওয়ার জন্য আমরা চিঠি দিয়েছি। বিএএসএ নেতাদের অনুরোধ করেছি। এখন তারা তাদের অ্যাসোসিয়েশনের সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন। এরপর নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত হলে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করা হবে।\হবিসিএস ট্রেড ক্যাডার অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন বলেন, ৩২টি পদ নিয়ে ট্রেড ক্যাডার দেশের জন্য অবদান রাখতে পারছে না। ফলে এই ক্যাডার দিয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করতে চাইলে পদসংখ্যা বাড়াতে হবে। পদ না বাড়ালে বিলুপ্ত করে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত করতে হবে। কারণ, ট্রেড ক্যাডারের পদগুলোতে এখন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। ফলে একটি ক্যাডারকে এভাবে রাখার কোনো মানে হয় না। তিনি বলেন, এ সমস্যা সমাধানের জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছি। সম্প্রতি প্রশাসনের সঙ্গে ট্রেড ক্যাডারকে একীভূত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পদসংখ্যা বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু জনপ্রশান মন্ত্রণালয় কোনোটাই এখনও করেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোসলেহ উদ্দিন আহমদ বলেন, উপসচিব থেকে উপরের পদগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব বেশি। তথ্য, ট্রেড, সমবায়সহ অনেকগুলো ক্যাডারে কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক কম। তারা সময়মতো পদোন্নতি পান না। একই প্রশ্নে পরীক্ষা দেওয়ার পরও তারা মন্ত্রণালয়ে কাজের সুযোগ পান না। ফলে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা মনে করেন প্রশাসনের সঙ্গে একীভূত হলে দেরিতে হলেও তারা উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব হতে পারবেন। সম্প্রতি ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা একীভূত হয়ে পদোন্নতি পাওয়ার ফলে অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের আগ্রহ বেড়ে গেছে। এতে তাদের ক্ষমতা বাড়বে। তিনি বলেন, প্রশাসনের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের একীভূত করতে চাইলে একসঙ্গে করা উচিত। কারণ সাধারণ ক্যাডারের কর্মকর্তারাও প্রশাসন ক্যাডারের মতো কাজ করে থাকেন। এই অধ্যাপক প্রস্তাব দেন, দেশে দুটি ক্যাডার থাকা উচিত- একটি সাধারণ অপরটি টেকনিক্যাল।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব ক্যাডারকে সমান সুবিধা দেওয়ার জন্য ২৯টি ক্যাডার তৈরি করেছিলেন। যাতে প্রত্যেক ক্যাডার স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সুযোগ পায়। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, এটা করলে দেশের জন্য ভালো হবে। থাকবে না আন্তঃক্যাডার বৈষম্য। প্রত্যেক ক্যাডার যথাযথ মূল্যায়ন পাবে। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী অগণতান্ত্রিক সামরিক-বেসামরিক সরকারগুলো নিজেদের স্বার্থে সিভিল সার্ভিসে বিভাজন সৃষ্টি করে। ফলে ক্যাডার কর্মকর্তারা দেশের চেয়ে নিজেদের ক্যাডারের স্বার্থ বড় বলে ভাবতে শুরু করেন। আর এ বিভাজনের ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম। এ যাবৎ গঠিত সব প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি ক্যাডার সংখ্যা কমিয়ে আনতে সুপারিশ করেছে। ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর পরিকল্পনা বিভাগের দারিদ্র্য বিশ্নেষণ ও পরিবীক্ষণ অনুবিভাগ আয়োজিত 'ষষ্ঠ (২০১১-১৫) পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন' সম্পর্কিত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির এক সভায় সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সরকারের ২৮টি ক্যাডার বিলুপ্তির পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, ২৮টি ক্যাডার না রেখে এদের ৫ থেকে ৬টি ক্লাস্টারে ভাগ করা হবে। ক্যাডারের সংখ্যা কমানো হলে সরকারের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম আরও বেগবান হবে।
বিসিএস সমবায় অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মাদ গালীব খান বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হওয়ার জন্য তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চলতি সপ্তাহে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও বিএএসএকে তারা চিঠি দেবেন এবং একীভূত হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাবেন। সমবায় ক্যাডার আপগ্রেডেশনের একটি ফাইল জনপ্রশাসনে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।\হবিসিএস ফুড অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, খাদ্য ক্যাডারের জুনিয়র কর্মকর্তারা প্রশাসনের সঙ্গে একীভূত হতে চান। কারণ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ডিসি ও ইউএনওরাও খাদ্য বিভাগের অনেক কাজ করছেন। একীভূত হলে খাদ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে পারবেন।\হপ্রশাসন ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এ বিষয়ে বলেন, সব ক্যাডারের বিষয়েই সমান আন্তরিক হতে হবে। প্রয়োজন আছে বলেই এত ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই কোনো একটি বিশেষ ক্যাডার দুর্বল হলে ওই সেক্টরটিই দুর্বল হয়ে পড়বে, তা কারও কাম্য নয়। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, কোনো ক্যাডার একীভূত হতে চাইলে আগে নিজেদের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এরপর আলোচনা করে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হবে।
সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, ফুড ক্যাডারের এন্ট্রি পদ হচ্ছে সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক (এসি ফুড)। এ পদের সংখ্যা ৬৯টি। অথচ এ পদে কর্মরত ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র ১৭ জন। আর সমবায় একটি ছোট ক্যাডার। আশির দশকে যে কয়েকটি পদ নিয়ে ক্যাডারটি যাত্রা শুরু করেছিল, এখনও সেই কয়েকটি পদই রয়েছে। বিসিএস পাস করে সমবায় ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উপজেলা পর্যায়ের পদ বা প্রারম্ভিক পদ অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ শুরু করার কথা। কিন্তু তারা কাজ শুরু করেন জেলা পর্যায়ের পদ ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে। অর্থাৎ এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার দিয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রারের কাজ চালানো হচ্ছে।\হ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ১০০টি পদ নিয়ে ট্রেড ক্যাডার গঠন করা হয়। এরপর ১৯৮৫ সালের ১১২টি পদ ১৯৯৪ সালে ১১৬টিতে উন্নীত হলেও বিদেশে বাণিজ্যিক মিশনসহ বিভিন্ন পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ায় এ ক্যাডারের পদ ৩২ এ নেমে এসেছে।
সূত্র: সমকাল