প্রশ্নফাঁস চক্রে বুয়েট শিক্ষক

নিজস্ব প্রতিবেদক |

রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় এবার উঠে এসেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষকের নাম। তিনি দীর্ঘ ৮ থেকে ১০ বছর আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপাতে প্রেসের টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে আসছেন। তার কাছ থেকে অতীতে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন নিয়েছে বলে দাবি করেছে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটির অফিস অ্যাটেনডেন্ট মো. দেলোয়ার হোসেন।

তবে গত ৬ নভেম্বরের প্রশ্ন দেলোয়ার সংগ্রহ করে আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি আশুলিয়ার যে প্রেসে প্রশ্ন ছাপায় সেখানকার কর্মচারী রবিউল আউয়ালের কাছ থেকে। রবিউল একসেট প্রশ্ন জামার মধ্যে লুকিয়ে প্রেস থেকে বাইরে নিয়ে আসে।

গত বুধবার ঢাকা মেট্রো পলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের (ডিবি) একটি দল দেলোয়ারসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে দেলোয়ার পুলিশকে দেওয়া ১৬১ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধরের কাছ থেকে এর আগে একাধিকবার প্রশ্ন নেওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। সে আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে একই কথা বলেছে। গ্রেপ্তার অন্যরাও দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘দেলোয়ার জবানবন্দিতে বলেছে বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক নিখিল রঞ্জনের কাছ থেকে একাধিকবার প্রশ্ন নিয়ে ফাঁস করেছে। এ ছাড়া সে আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটির শরীফুল নামে আরও একজনের নাম বলেছে। এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে।’

বুয়েটের শিক্ষকের সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ওয়াহিদুল ইসলাম গতকাল শুক্রবার রাতে বলেন, ‘সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলে তার বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

তবে বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি কোনো কোশ্চেন (প্রশ্ন) করি না, মডারেশনের সঙ্গেও জড়িত না। আমি প্রেসে যাই লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। ওনারা (প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটি) প্রশ্ন করেন, সিলগালা করেন, ওনাদের কাছেই প্রশ্ন রাখেন। আমি এসবের কোনো কিছুতেই ছিলাম না। কখনোই আমি এসবে (প্রশ্নফাঁস) জড়িত ছিলাম না।’

প্রশ্ন প্রণয়নের কোনো কমিটিতে না থাকার পরও কেন প্রেসে যেতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সেখানে ক্লাস নিই। ভিসি স্যার আমাকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপাতে সহায়তার জন্য বলেছেন। এজন্য আমি গিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘দোলোয়ার একজন পিয়ন, ওর সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি।’

প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমানুল্লাহ বলেন, আমি বেশিদিন এ প্রশ্ন ছাপানোর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। তবে বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধর ৮-১০ বছর ধরে প্রশ্ন ছাপাতে প্রেসে সহায়তা করছে। আমার সঙ্গেও সে গিয়েছিল। তবে প্রশ্নফাঁসে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’

৬ নভেম্বরের প্রশ্নটি প্রেস থেকে কর্মচারী রবিউল ফাঁস করেছে ডিবির এমন দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কী করার আছে।’ প্রেসের নিরাপত্তার বিষয়ে তিনিও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সেখানে কোনো পুলিশ বা নিরাপত্তা ছিল না।’

এদিকে গ্রেপ্তার দেলোয়ার জিজ্ঞাসাবাদে তদন্তসংশ্লিষ্টদের জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অল্প টাকায় পরীক্ষার টেন্ডারগুলো আনতেন বুয়েটের শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর। তিনিই সব কাজ করতেন এবং সব নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই কাজের জন্য তিনি খুব মরিয়া থাকতেন। প্রতিবার প্রশ্ন ছাপার পর দুই সেট প্রশ্ন তিনি ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতেন। দেলোয়ার নিজেও অনেকবার তার ব্যাগে প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছে। কোনো প্রশ্ন বা শব্দ করলে চাকুরি খেয়ে ফেলবেন বলে তিনি দেলোয়ারকে হুমকি দিতেন।

গত ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি সরকারি ব্যাংকের ‘অফিসার ক্যাশ’ পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। ওই এখন পর্যন্ত মোট ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। এর মধ্যে প্রথমে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তারা হলেন জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা শামসুল হক শ্যামল, রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা জানে আলম মিলন ও পূবালী ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান মিলন, জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার এমদাদুল হক খোকন ও সোহেল রানা (আগেই চাকরিচ্যুত), প্রশ্নফাঁসে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ চক্রের এজেন্ট ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী এবি জাহিদ. চাকরিপ্রার্থী রাইসুল ইসলাম স্বপন ও আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির হার্ডওয়্যার ও নেটওয়ার্কের টেকনিশিয়ান মো. মোক্তারুজ্জামান রয়েল। সর্বশেষ গত বুধবার গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন হলোÑআহছানউল্লা ইউনিভার্সিটির অফিস অ্যাটেনডেন্ট মো. দেলোয়ার হোসেন, সাভারের আশুলিয়ায় অবস্থিত আহছানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের কর্মচারী মো. রবিউল আউয়াল ও আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটির ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট মো. পারভেজ মিয়া।

তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি থেকেই প্রশ্নফাঁস হয় বলে নিশ্চিত হয়েছে।  অন্তত ২ হাজার পরীক্ষার্থী এ প্রশ্ন পান। আর চক্রটি প্রশ্ন ও উত্তর বিক্রি করে বাগিয়ে নেয় ৬০ কোটি টাকারও বেশি।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় পাঁচ ব্যাংকের অফিসার (ক্যাশ) পদে গত ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়া প্রিলিমিনারি পরীক্ষাটি বাতিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024092197418213