প্রসঙ্গ নিরাপদ ক্যাম্পাস

ড. মো. সোহেল রহমান |

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রকৌশল শিক্ষা ও গবেষণার পীঠস্থান বুয়েটকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা নিশ্চয়ই আপনাদের নজরে এসেছে—ঘটনা না বলে হয়তো দুর্ঘটনা বলাই ভালো। ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা এবং কিছু দুষ্কৃতকারী সন্ত্রাসী বুয়েটের শিক্ষার্থীদের তাঁদেরই ক্যাম্পাসে এবং হলে এসে পিটিয়ে গেছে।

সিসিটিভির কিছু ফুটেজ এ ঘটনার সত্যতা সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণ করে। বিষয়টা খুবই সহজ হতে পারত। এই দুষ্কৃতকারী সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করা যেত (সফলতার প্রশ্নে যাচ্ছি না যদিও)। কিন্তু সমস্যা হলো, এই দুষ্কৃতকারী সন্ত্রাসীদের মধ্যে একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলের ছাত্র। পুরো ঘটনার রং পাল্টে দেওয়ার জন্য এই তথ্যই যথেষ্ট! এবং তা-ই ঘটল! আমরা আবার এই প্রসঙ্গে ফিরে আসব কিন্তু আগে একটু প্রসঙ্গান্তরে যাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব সব সংগ্রাম থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পর্যন্ত এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ অন্য অনেক যৌক্তিক আন্দোলনে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই আমাদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিক—যেকোনো ক্ষেত্রেই যেকোনো অন্যায়-অবিচারে আমরা আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেই চেয়ে থাকি এই জন্য যে ওখান থেকেই আমাদের আন্দোলনের নেতৃত্ব আসবে।

কিন্তু যখন বিপরীত ঘটনাটা ঘটে? যখন সরষের মধ্যেই ভূত কাজ করা শুরু করে? যখন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস পদদলিত করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই কোনো ছাত্র কোনো একটা চরম অন্যায় করে ফেলে, তখন কী ঘটে? তখন কি বাকিরা চোখ বন্ধ করে তাকে বা তাদের সমর্থন দিতে পারে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পারে না। একটু দেরি হতে পারে কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে প্রতিবাদ আসবেই, সেই অন্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কেউ করলেও। খুব সাম্প্রতিকের একটা উদাহরণ মনে পড়ে। উল্টো পথে চলার উদাহরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বহন করে নেওয়া বাসের উল্টো পথে চলার ঘটনা বহু পুরনো। কিন্তু এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথম সোচ্চার যাঁরা হয়েছেন, তাঁরাও মূলত এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র। এ প্রসঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং উঠতি লেখক যোবায়েদ আহসানের কথা বলতেই হয়। ঢাবির এই প্রাক্তন ছাত্র একাই ফেসবুকের মাধ্যমে এক অসাধারণ আন্দোলনের ডাক দেন : উল্টো পথে চলা গাড়ি তাঁর সামনে পড়লেই তিনি ফেসবুকে লাইভ হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়তেন। আমি বিশ্বাস করি, এর পরবর্তী সময়ে উল্টো পথে চলা নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশংসনীয় অবস্থানসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে যে সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে, তার একটা বড় কৃতিত্ব এই ঢাবির প্রাক্তন ছাত্রের। শুধু তিনি নন, সাম্প্রতিক সময়ে কিংবা তারও আগে থেকেই এই বিষয় নিয়ে ঢাবি পরিবারের সদস্যরাই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন, যেমনটি আমরা আশা করি।

তো মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বুয়েটে হামলাকারী দুষ্কৃতকারী সন্ত্রাসীদের মধ্যে একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলের ছাত্র—ব্যাপারটি পুরো ঘটনার রং পাল্টে দিল। পুরো ঘটনায় রং দেওয়া হলো ঢাবি বনাম বুয়েটের ছাত্রদের খণ্ডযুদ্ধ হিসেবে, যেই যুদ্ধের মূল অনুষঙ্গ হিসেবে একবার রাজনৈতিক মারামারি, আরেকবার দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কল্পিত যুগলের গল্প নিয়ে আসা হলো। একদিকে গুজব ছড়িয়ে গেল যে এটি ঢাবি ও বুয়েটের রাজনৈতিক ছেলেপিলের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব; আবার অন্যদিকে গুজব ছড়িয়ে গেল যে বুয়েটের ছাত্ররা বুয়েটের এক ছাত্রীর বন্ধু ঢাবি ছাত্রকে পিটিয়েছে এবং ধরে রেখেছে, যার প্রতিশোধ নিতেই ঢাবির দুই হলের ছাত্রদের আক্রমণ। অথচ এই কথিত ঢাবি ছাত্রের আর কোনো খবরই কোথাও পাওয়া গেল না। অন্যদিকে সত্য ঘটনা হলো যে ওই দুষ্কৃতকারী সন্ত্রাসীদের আক্রমণে আহত বুয়েটের ছাত্ররা কিন্তু বাস্তবিকই হাসপাতালে ভর্তি! দুঃখজনক হলেও সত্য, অসতর্কভাবেই হোক কিংবা যথাযথভাবে সত্যতা যাচাই না করার কারণেই হোক—এই ভুল সংবাদগুলো এমনকি কয়েকটি প্রধান সংবাদমাধ্যমেও প্রচার করা হয়েছে বেশ ফলাও করেই। তার ফলে যা হয়েছে তা হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অনেকেই বিষয়টিকে ভুল জেনে, ভুল বুঝে বিশেষত সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বুয়েটের ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো মাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে, যা দুই পরিবারের মধ্যে একটা তিক্ত ক্ষতের সৃষ্টি করে চলছে, যার প্রভাব হয়তো আমাদের অনেক দিন বহন করতে হবে।

বুয়েটের ক্যাম্পাসে এ ধরনের বহিরাগত আক্রমণের ঘটনা নিকট-ইতিহাসে তেমন নেই। নব্বইয়ের দশকের একটা বহুল আলোচিত ঘটনা আছে, যা আমরা স্মরণ করতে চাই না। বস্তুত সেই ঘটনার পর কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, যার সুফল নিশ্চিতভাবেই আমরা ভোগ করেছি। কিন্তু এখন আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার প্রশ্ন আমাদের সামনে। আমাদের অবশ্যই সম্মিলিতভাবে এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে। ইতিমধ্যে বুয়েট কর্তৃপক্ষ ঢাবি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যৌথভাবে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। ঢাবির অনেক সম্মানিত শিক্ষক এবং বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা এ বিষয়ে নিন্দা জানিয়েছেন এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য (সামাজিক) আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। বুয়েটের ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার এই যে দাবি উঠেছে, তা যেন শুধু বুয়েটেই সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের যথাযথ নিরাপত্তার দাবিতে পরিণত হয়, সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

পরিশেষে আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে দুষ্কৃতকারীদের হামলার তীব্র নিন্দা জানাই এবং কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে আশু এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করি। আমরা বিশ্বাস করি যে এই দুষ্কৃতকারীরা যেই দল-মত-পথেরই হোক না কেন, তারা কোনোভাবেই কারো নৈতিক বা অন্য কোনোভাবে সমর্থন পাবে না। এদের আইনের আশ্রয়ে আনতে সাহায্য করা বাংলাদেশের সব নাগরিকেরই নৈতিক দায়িত্ব। শিক্ষা পরিবারের অংশ হিসেবে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব এই ক্ষেত্রে আরো বেশি। সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, বুয়েট

সূত্র: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031180381774902