প্রসঙ্গ শিক্ষক নিবন্ধন : টার্মিনাল আর লঞ্চের টিকিট এক নয়

সিদ্দিকুর রহমান খান |

সালাম জানাতেই স্যার বললেন, আপনাকেই খুঁজছিলাম। শিক্ষার সবকিছুতে আপনি থাকেন তো, শাহবাগে নিবন্ধিত শিক্ষক প্যানেল প্রত্যাশীদের সম্পর্কে আমাকে কিছু জানালেন না যে? এ লেখককে উদ্দেশ্য করে এমন অধিকারমাখা কথা সর্বজনমান্য শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের। 

তারিখটা ৮ জানুয়ারি ২০২২, সকাল। অনশনরতদের অনশন ভাঙানো এবং পত্রিকায় স্যারের একটা লেখা পড়েই সাত সকালে ফোন করেছিলাম। তার সম্মতি নিয়ে নিবন্ধন সনদধারীদের আন্দোলন সম্পর্কে বোঝাতে শুরু করলাম। বললাম: মনে করি আমি লঞ্চযোগে বরিশালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিকেলে ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছুলাম। শুধু ঘাটে প্রবেশের জন্য টার্মিনাল টিকেটের দাম দশ টাকা। একটা কিনে ঢুকলাম। সারারাত ওই টিকিটটাই যত্ন করে রেখে ওটা দেখিয়েই আমি বরিশাল সদরঘাটে পৌঁছে লঞ্চ থেকে নেমে যেতে চাইলাম। টিকিট চেকারকে সেই দশ টাকায় কেনা টার্মিনাল টিকিটটা দিলাম। তিনি বললেন, এটাতো টার্মিনাল টিকিট। সদরঘাটে প্রবেশের জন্য বাধ্যতামূলক। আমাদের লঞ্চের সিঙ্গেল কেবিনে চড়ে বরিশালে এসেছেন তার জন্য লঞ্চভাড়া দিতে হবে। তার টিকিট আলাদা, সেটা কই? সেটার দাম এক হাজর দুশো টাকা। আমি প্রথমে দিতে চাইলাম না। উল্টো তাকে উকিল নোটিশ, রিট ও হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট দেখানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু উপস্থিত অন্যান্য যাত্রীরা আমাকে বোঝাতে চাইলেন। বললেন, ভাই এটা আদালতের বিষয় না। এটা নির্বাহী বিষয়। লঞ্চ কর্তৃপক্ষের নির্বাহী আদেশ। তারা তেল ও এসি খরচ করে আপনাকে ঢাকা থেকে বরিশালে নিয়ে এসেছেন। বহুপূর্বে ঘোষিত টিকেটের দাম এক হাজার ২০০ টাকা দিয়ে টিকিট নিয়ে লঞ্চ ছাড়ুন। বাড়ী চলে যান। টার্মিনাল টিকিট আর লঞ্চের ভাড়ার টিকিট আলাদা। 

কিন্তু আমি নিয়মিত ও অভিজ্ঞ যাত্রীদের পরামর্শ শুনলাম না। আমি সংবাদ সম্মেলন, অনশন, রিট ইত্যাদির হুমকি দিলাম লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে। তো, স্যার লঞ্চ কর্তৃপক্ষ এখন কি করবেন? এক নাগাড়ে বলে গেলাম। 

গভীর মনোযোগে শুনছেন স্যার। যাদের জন্য আপনি দুকলম লিখেছেন, তাদের নিবন্ধন সনদগুলো টার্মিনাল টিকিট। আরো বলি, স্যার আইনের ডিগ্রিধারী হলেই তো মামলা লড়তে গাউন পরে বিচারকের সামনে দাঁড়ানো যায় না। বার কাউন্সিলের সনদ লাগে। তেমনি ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে যখন নিবন্ধন সনদ পদ্ধতি শুরু হয় তখন উদ্দেশ্যই ছিলো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণী সনদ দেয়ার। নিয়োগের জন্য বেসরকারি পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে আলাদা পরীক্ষা।  

তারপর বলি, স্যার ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু হয়ে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর অথবা প্রথম থেকে ১২তম নিবন্ধন সনদ দিয়ে সরাসরি শিক্ষক পদে নিয়োগ পেতে চাওয়া সদরঘাটের দশ টাকার টিকিটে সুন্দরবন লঞ্চের কেবিনে চড়ে বরিশাল যেতে চাওয়ার মতোই। অযৌক্তিক দাবি বলতে পারেন। স্যারকে আরো বলি - ওই সনদগুলো শুধু শিক্ষক পদে চাকরির জন্য আবেদন করার যোগ্যতা অর্জনের। নিয়োগ পেতে হলে বেসরকারি কর্তৃপক্ষের নেয়া নিয়োগ পরীক্ষাই চূড়ান্ত ছিলো। সে সময়ে নিয়োগে এনটিআরসিএর কোনো ভূমিকা ছিলো না। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে গেজেট জারির মাধ্যমে এন্ট্রি লেভেলে [প্রভাষক, সহকারি শিক্ষক, মৌলভী] শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব পায় এনটিআরসিএ। প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয় ভাইভা। তখন থেকে এনটিআরসিএ কর্তৃক বাছাইকৃত ও মনোনীত সনদধারীদের আর কোনো পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি নিয়োগ দেয় বেসরকারি স্কুল/কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটি।  ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা থেকে অদ্যাবধি এই পদ্ধতি চলে আসছে অথবা আসার কথা।  

আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রাখার আগে স্যার বললেন, ‘আমার নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র ভুক্তভোগী। শাহবাগে তারা অনশনরত, ‘তারা আমাকে বলেছে যে সনদ থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে নিয়োগবঞ্চিত করা হচ্ছে, তাই আমি ওখানে গিয়েছিলাম, আর একটু লিখেছিলাম।’ সব শুনে স্যার বললেন, ‘ধন্যবাদ, এবার বিষয়টা বুঝলাম।’ 

সেই থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষাবিদ ও জনপ্রিয় লেখক জাফর ইকবাল স্যার আর সেইসব নিবন্ধনধারীদের শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য কোনো কিছু বলেছেন বা লিখেছেন বলে আমি শুনিনি, দেখিনি কিংবা পড়িনি।

পরবর্তী কিস্তি : শিক্ষক নিয়োগে ভাইভার নম্বর যোগ না করা কেনো অবৈধ হবে না


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিওভুক্তির নতুন আদেশ জারি - dainik shiksha এমপিওভুক্তির নতুন আদেশ জারি জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর শিক্ষা প্রশাসনে বড় বদলি - dainik shiksha শিক্ষা প্রশাসনে বড় বদলি কুবির বঙ্গবন্ধু হল ও শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন - dainik shiksha কুবির বঙ্গবন্ধু হল ও শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন ডিআইএ পরিচালক কাজী কাইয়ুম শিশিরকে বদলি - dainik shiksha ডিআইএ পরিচালক কাজী কাইয়ুম শিশিরকে বদলি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনে শহীদদের স্মরণসভা - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনে শহীদদের স্মরণসভা সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১১ হাজার শিক্ষক - dainik shiksha এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১১ হাজার শিক্ষক পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029251575469971