রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৬ সালে শিক্ষা সংকটে লিখেছেন, ‘কোন মতে সাড়ে ৯টা, সাড়ে ১০টার মধ্যে তাড়াতাড়ি অন্ন গিলিয়া বিদ্যা শিক্ষার হরিণ বাড়ির মধ্যে হাজিরা দিয়া কখনোই ছেলেদের প্রকৃতি সুস্থভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে না। শিক্ষাকে দেয়াল দিয়া ঘিরিয়া গেট দিয়া রুদ্ধ করিয়া দারোয়ান দ্বারা পাহারা বসাইয়া, শাস্তি দ্বারা কণ্টকিত করিয়া ঘণ্টা দ্বারা তাড়া দিয়া মানব জীবনের প্রারম্ভে একি নিরানন্দের সৃষ্টি করা হইয়াছে। শিশু যে এলজেব্রা না কষিয়া ইতিহাসের তারিখ মুখস্থ না করিয়াই মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াছে সেজন্য সে কী অপরাধী? তাই সে হতভাগ্যদের নিকট হইতে তাহাদের আকাশ-বাতাস, তাহাদের আনন্দ অবকাশ সমস্ত কাড়িয়া লইয়া শিক্ষাকে সর্ব প্রকারে তাহাদের পক্ষে শাস্তি করিয়া তুলিতে হইবে।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই বিশ্বখ্যাত সফল ব্যক্তিদের ভাবনা। তাদের অনেকের কাছে স্কুলকে জেলখানা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। বেশির ভাগই প্রাতিষ্ঠানিক রেজাল্ট ভালো ছিল না। নিজেদের স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে শিক্ষাজীবনে সেরা ছাত্রটি হতে পারেননি।
বিশ্বের সফল ব্যক্তিরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেরা ছাত্রের তকমা না পেলেও সফল মানুষের স্বীকৃতি পেয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় কমতি থাকলেও আত্ম-শিক্ষায় বলীয়ান থাকার কারণে নিজের স্বপ্ন পূরণে সার্থক হয়ে বিশ্বে অমর হয়ে আছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভালো কোটি কোটি শিক্ষার্থীর কথা মানুষ মনেই করে না। প্রদীপ শিখার মতো কিছু সময়ের জন্য কিছু মানুষকে আলোকিত করে দমকা বাতাসে হঠাৎ করেই নিভে গিয়েছে। সাময়িকভাবে উজ্জ্বল হলেও স্থায়িত্ব লাভ করেনি। জার্মান দার্শনিক হেগেল বলেছেন Be a person একথার মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন মানুষ নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়ে অপর ব্যক্তির কল্যাণ সাধনের মধ্য দিয়ে চেষ্টা করে আত্মবিস্তৃতি লাভের অর্থাৎ মানুষ নিজেকে বিনির্মাণ করে গড়ে তোলে কতগুলো মহৎ গুণের সমন্বয়ে। আর মানব জীবনে অর্জিত মহৎ গুণাবলীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব যা প্রতিটা জীবনের জন্য অপরিহার্য। মানুষ তার ছোট জীবনকালে এমন সব কীর্তিময়, মহান, মহৎ কাজ করে যাবে যে কাজ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল। মানুষ অমরত্ব লাভ করবে তার কীর্তিময় কাজের মাঝে। দৈহিকভাবে মানুষটার বিনাশ হবে কিন্তু কর্মফল তাকে এই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সার্থক মানবজীবন পাওয়া কষ্টসাধ্য। এর জন্য প্রয়োজন আত্ম-শিক্ষা।
বাংলাদেশে এখন আমরা বিদ্যালয়কে পরম শিক্ষার স্থান মনে করছি। একটা ভালো গ্রেড পাওয়ার সংগ্রামে নিবেদিত। গ্রেডের মানদন্ডে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতাকে যাচাই করা হচ্ছে। অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সকলের সাথে সরকারও প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিশ্বের শিক্ষায় এটাই এক উপায়। কিন্তু বিদ্যালয়ের ভালো গ্রেড দিয়েই একজন শিক্ষার্থীর প্রতিভা এবং মেধা বুঝা সম্ভব? মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় কিছু বিষয়ে অকৃতকার্য হতো এবং তার এক বন্ধু সকল বিষয়ে কৃতকার্য হতো। বিল গেটসের সেই বন্ধুটি এখন একজন মাইক্রোসফট প্রকৌশলী আর গেটস মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা। বিল গেটসরা পড়াশোনা করেছেন জানার জন্য, শ্রেণীকক্ষে ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য নয়। বিশ্বের এমন সফল ব্যক্তিরা বিদ্যালয়কে পরম শিক্ষার স্থান মনে না করে নিজেদের স্বপ্ন পূরণে আত্ম-শিক্ষায় বলীয়ান হয়েছেন।
আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে দিতে সহশিক্ষা কার্যক্রম গুরুত্বহীন করে তুলেছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের ভাগ্য অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। তার পছন্দ অপছন্দের কোন মূল্যই নেই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে। শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে গুরুত্ব দেয়ার কোন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়নি। জাতি হিসেবে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি করতে চলেছি কিন্তু আমাদের কোন মানবসম্পদ পরিকল্পনা নেই। দেশের জন্য কতজন ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, নার্স ইত্যাদি পেশাজীবী প্রয়োজন তার কোন হিসেব নেই। জনসংখ্যাকে জনসম্পদ বিবেচনা করে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে শিথিলতা এনে দেশকে জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ করে তোলা হচ্ছে। আর ব্যাঙের ছাতার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে বেকার তৈরির কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহ করা হচ্ছে। শুধু এখানেই থেমে নেই পেশাগত জীবনে ডাক্তাররা পুলিশে, প্রকৌশলীরা প্রশাসনে, কৃষিবিদরা কাস্টমসে পেশা হিসেবে জীবন গড়ে তুলছেন।
মানবসম্পদ পরিকল্পনা না থাকায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের স্রোতের টানে ছেড়ে দিয়েছে। বিশ্বের সফল ব্যক্তিদের সকলে সংকল্প নিয়ে বা স্বপ্ন দেখে তা বাস্তবায়নে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় রেখেছেন। তাদের মতে স্বপ্ন দেখতে হবে বিশাল। যদি করো স্বপ্ন দেখে কেউ না হাসে তাহলে বুঝতে হবে স্বপ্নটা অনেক অনেক ছোট। বড় স্বপ্ন পূরণে সাহসী হতে হয়, নির্ভীক হতে হয়। এখানে কোন কাজ নিরাপদ নয়। বিশ্বের সফল ব্যক্তিরা প্রচলিত ধারার মধ্যে নিজেদের বেঁধে রেখে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করেননি। তারা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণের স্বপ্ন দেখেছেন। তারপর লক্ষ্য ঠিক করে তা বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বপ্ন দেখার কোন পরিবেশ গড়ে তোলা হলো না। সৃজনশীলতা চর্চার বদলে শিক্ষার্থীরা এখনো মুখস্থ বিদ্যায় ভর করে সনদপ্রাপ্ত হচ্ছে। শিক্ষার্থী কি শিখলো বা শেখানো হলো তা বিবেচ্য নয়, একটা ভালো গ্রেড চাই। সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীদের একমাত্র মোক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সবার চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সহায়তায় শর্টকাট পথ হিসেবে কোচিং ও গাইড বইয়ের ব্যবসাকে রমরমা করে তুলেছে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে যে পুরো বই পড়ে ভালোভাবে জানতে হয় তারপর নিজের মতো করে উত্তর লিখতে হয় তা আমাদের সৃজনশীলতার মধ্যে নেই। এখনো পাঠ্য বইয়ের নির্ধারিত কিছু অংশ পড়লেই চলে। ছকে বাঁধা পথ তৈরি করা হয়েছে ভালো গ্রেড পাওয়ার জন্য, শতভাগ পাসের গৌরবগাঁথা সৃষ্টির জন্য। আপাতত এখনো মুখস্থ বিদ্যার জয়জয়কার চলছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা সর্বত্র একই অবস্থা বিরাজমান। রাজনীতি থেকে শুরু করে সবাই খুশি। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেদের জাহির করে চলেছে। সমস্যা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য এরা শিক্ষা জীবন শেষে পেশা গ্রহণের সময় দাঁত বের হয়ে পড়ে। যারা এতদিন সুখী ছিল তাদের একটা অংশ এবার মানসম্মত শিক্ষার অভাব অনুভব করে উচ্চবাচ্য শুরু করে।
আমরা কেউ মানহীন শিক্ষার দায় এড়িয়ে যেতে পারবো না। শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক সংস্থার মন্ত্রী-সচিব থেকে শুরু করে অভিভাবক, শিক্ষক কেউ দায় এড়াতে পারবো না। মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ না করে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, প্রশাসক, কৃষিবিদ, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, কাস্টমস, ব্যাংকার হওয়ার প্রতিযোগিতায় সামিল হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখাতে, মেধা বিকাশে, যুগোপযোগী করতে মেধাবী শিক্ষকের বিকল্প নেই। অথচ আমরা শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছি যেখানে মেধাবীরা আসার ন্যূনতম সুযোগ পায় না। মেধাবীদের স্বপ্নের পেশার মধ্যে শিক্ষকতার কোন স্থান নেই। স্বপ্নবিহিন শিক্ষক দিয়ে কী স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থী তৈরি করা যাবে? তার ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষকদের যুগোপযোগী করার উদ্যোগের বহু ফাঁক। শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতির মধ্যে নিজেরা ছিল না সেই শিক্ষকদের দিয়ে এই পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। সরকারি দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষার প্রশিক্ষণকে যথেষ্ট বিবেচনা করলেও সাধারণ শিক্ষকদের মতে তা অপ্রতুল। বাস্তব ক্ষেত্রেও প্রমাণিত হয়েছে প্রশিক্ষণ অপ্রতুল। দেশের বিপুলসংখ্যক শিক্ষক এখনো প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন না বলে জাতীয় পত্রিকায় খবর হয়েছে। দেশে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করতে মোট কত টাকা ব্যয় হয়েছে যার মধ্যে মূল শিক্ষক প্রশিক্ষণের অংশ কত হিসেব করলেই অনেক প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যাবে।
দেশের শিক্ষাবিদদের পেছনে রেখে রাতে স্বপ্ন দেখে সকালে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনলে শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখানো যাবে না। রাতে স্বপ্ন দেখলাম সকালে গ্রেড পদ্ধতি চালু করে দিলাম, চার বছরের অনার্স কোর্স, ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা, সৃজনশীল পদ্ধতি, পিএসসি-জেএসসি পরীক্ষা প্রবর্তন, ইত্যাদি চালা করা হয়েছে। সাধু উদ্যোগগুলো সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণে জাতি তার সুফল থেকে এখনো বঞ্চিত। নতুন কিছু বিষয় চালু করার জন্য প্রস্তুতি সময় প্রয়োজন। আমরা কোনখানে প্রস্তুতি সময় দিতে রাজি নই। নিজের বা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে প্রস্তুতি সময় গৌণ হয়ে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে আজ প্রশ্নের মুখে তুলে দিয়েছি। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কারিগররা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গিয়েছে, দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের জয়জয়কার চলছে, হতাশা আর অবসাদে নিমজ্জিত হচ্ছে। মানুষ জীবিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে ভাগ্য তৈরির কথা ভুলে গিয়েছে।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা মানসম্মত না হওয়ায় জীবিকার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। নিজেকে মানসম্মত করতে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে, সোনার বাংলা গড়তে আত্ম-শিক্ষার আজ বড়ই প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক অনেক মেধাবী। একান্ত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নাসা থেকে ইথোপিয়ায় তারা যোগ্যতার প্রমাণ রেখে চলেছে। আমাদের সামান্য দায়িত্বশীলতা শিক্ষার্থীর ভাগ্য গড়তে সহায়ক হতো। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন সম্ভব হতো। শিক্ষার্থীরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে দৃঢ়তা দেখাতে পারতো। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষকে যোগ্যতা প্রমাণের দৃঢ়তা দিতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন আত্ম-শিক্ষা। তাই বিশ্বের সফল ব্যক্তিরা বলেছেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবিকা দেবে আর আত্ম-শিক্ষা ভাগ্য দেবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিন্তা করতে হবে আমরা শিক্ষাকে জীবিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবো, না ভাগ্য গড়তে সহায়ক করবো।