প্রাথমিকের সংশোধিত নিয়োগ বিধি ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’

নিজস্ব প্রতিবেদক |

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংশোধিত বিধিমালা সচিব কমিটিতে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে, নতুন বিধিমালা বাস্তাবায়নের আগেই নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে শিক্ষকরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। শিক্ষকরা বলছেন, নতুন বিধিমালায় তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সংশোধিত নিয়োগ বিধিতে প্রধান শিক্ষকদের কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির সুযোগ দেয়া হয়নি, বরং বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে তাদের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়নি। আবার ৪৫ বছর বয়স হওয়ার বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়েছে। অপর দিকে সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির সুযোগ দেয়া হলেও তাদের কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির সুযোগ দেয়া হয়নি। এসব অভিযোগ তুলে সংশোধিত নিয়োগ বিধিমালা প্রত্যাখ্যান করেছেন তারা।

শিক্ষক নেতারা বলছেন, আগের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিবরা সাধারণ শিক্ষকদের পদোন্নতির আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষকদের মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে সাবেক কর্মকর্তারা বাহবা নিয়েছেন। সংশোধিত নিয়োগ বিধিকে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন শিক্ষকরা। 

গত মঙ্গলবার বিকেলে বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের উদ্যোগে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সভায় শিক্ষকরা সংশোধিত নিয়োগ বিধিমালা প্রত্যাখ্যান করেছেন। সংগঠনের সভাপতি শাহিনুর আল-আমীনের সভাপতিত্বে এ ভার্চুয়াল সভা সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মায়েদুল হক বসুনিয়া ও মো. মাসুদ রানা। 

আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা

সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ ইলিয়াছ হোসাইন বলেন, নতুন নিয়োগ বিধিমালায় আমাদেরকে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। একজন সহকারী শিক্ষক চাকরি জীবনের একেবারে শেষ পর্যায় গিয়ে সাধারণত প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পান। অনেক সহকারী শিক্ষকের ভাগ্যে সেটাও জোটে না। 

তিনি আরও বলেন, নিয়োগবিধিতে শিক্ষকদের জন্য কোন সুখবর নেই বরং দুঃসংবাদ আছে।  নতুন নিয়োগবিধিতে বলা হয়েছে, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও ইউআরসির সহকারী ইন্সট্রাক্টর পদে ৮০ শতাংশ বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে প্রধান শিক্ষাকরা নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন, তবে বয়স ৪৫ এর বেশি নয়। যেহেতু সাধারণ প্রার্থীদের সাথে পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে তাহলে তো এটা পদোন্নতি হলো না। 

শিক্ষক নেতা আব্দুল ওহাব সুমন বলেন, আমরা অনেক দিন ধরে দাবি করে আসছি সহকারী শিক্ষক থেকে শতভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক হওয়ার এবং প্রধান শিক্ষক পদে সরাসরি আর কোন নিয়োগ হবে না। সাবেক সচিব মহোদয় এ বিষয়ে বলেছিলেন, আর কোন দিন প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ হবে না। ধরে নিলাম প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতি হবে। যদি তা হয়ও, তাহলেও একজন সহকারী শিক্ষক তার চাকরির শেষ বয়সে এসে প্রধান শিক্ষক হবেন। কিন্তু বয়সের বারের কারণে এবং পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের কারণে কখনোই কোন শিক্ষক আর সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার হতে পারবেন না। তাই, আমরা চাই সহকারী শিক্ষকদেরও বিভাগীয় প্রার্থীতার সুযোগ দিতে হবে। সচিব কমিটিতে অনুমোদিত নিয়োগবিধি শিক্ষক বান্ধব না হওয়ায় আমরা প্রত্যাখ্যান করলাম।  

সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা বলেন, একজন প্রাথমিক শিক্ষক যে পদে যোগদান করেন ঐ পদ থেকেই সাধারণত তাকে অবসর নিতে হয়। কারণ তার ভাগ্যে কোন পদোন্নতির সুযোগ আসে না। মাত্র ১৫ ভাগ সহকারী শিক্ষক চাকরি জীবনে একবার পদোন্নতি পান। সেটাও আবার স্ব-বেতনে। এই কারণে মেধাবীরা এই পেশায় আসতে চায় না এবং আসলেও থাকতে চায় না। এটা এখন মেধাবীদের একটা ট্রানজিট পেশায় পরিণত হয়েছে। যোগ্যতা অনুযায়ী শতভাগ প্রমোশন চালু না করলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ মানসম্মত শিক্ষক এই পেশায় থাকছে না। আর যারা আছেন তাদের পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণ যোগাতে অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে বিঘ্নিত হয় মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। 

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন

সভাপতি শাহিনুর আল আমিন বলেন, শিক্ষকতা পেশাটি এখনও আমাদের দেশে তেমন জনপ্রিয় না হওয়ায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করে এই পেশায় আসতে অনীহা প্রকাশ করে। আমাদের দাবি বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষকতার পেশাকে আর্কষণীয় করে যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে এই পেশায় নিয়ে আসতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এসব প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বাড়বে এবং শিক্ষার মান উন্নয়ন ঘটবে।

প্রাথমিক শিক্ষকদের ২০০ টাকা টিফিন ভাতা নিয়েও সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষকরা। সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিবুল হক বসুনিয়া লজ্জাকর টিফিন ভাতা নিয়ে বলেন, আমরা এই অপমানজনক, লজ্জাকর, হাস্যকর টিফিন ভাতা সরকারের কাছে প্রতিবাদ হিসাবে ফেরত দিতে চাই। সভায় উপস্থিত সকল সদস্য এক বাক্যে বলেন, অচিরেই আমরা এই অসম্মান জনক ২০০টাকা টিফিন ভাতা চালানের মাধ্যমে প্রতিবাদ হিসেবে ফেরত দেবো। 

সভায় সংগঠনের পক্ষ থেকে ১৫টি দাবি উত্থাপন করা হয়। সংগঠনের দাবি গুলো সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে বেতন নির্ধাারণ করতে হবে, সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতি দ্রুত বাস্তবায়নসহ মহা-পরিচালক পর্যন্ত যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দিতে হবে, প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত বিভাগীয় নীতিনির্ধারনী সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে, জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ অর্থ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিতে হবে, প্রতি তিন বছর পরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে শ্রান্তি বিানোদন ভাতা দিতে হবে, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগকে নন-ভ্যাকেশনাল ঘোষণা করে সরকারের অন্য ডিপার্টমেন্টের মত সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে, প্রথম যোগদানের তারিখ ধরে জাতীয় পর্যায়ে একটা গ্রেডেশন করতে হবে, ১৩তম গ্রেড বাস্তবায়নে জটিলতা নিরসন করতে হবে, ডিপিএড প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণভাতা দ্রুত ছাড় দিতে হবে এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার ফলে যাদের বেতন কমেছে, তাদের বেতন দ্রুত উচ্চধাপে ফিক্সেশন করতে হবে। যেহেতু ডিপিএড একটি দেড়বছরের প্রশিক্ষণ কোর্স, তাই প্রশিক্ষণোত্তর স্কেল ফিরিয়ে দিতে হবে এবং প্রশিক্ষণ শেষে উচ্চধাপে বেতন নির্ধারণ করতে হবে।

শিক্ষকদের দাবিগুলোর মধ্যে আরও আছে, চাকরি ২বছর পূর্ণ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থায়ীকরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে, নাম মাত্র টিফিন ভাতা মাসিক ২০০টাকার স্থলে দৈনিক নূন্যতম ১০০ টাকা হারে উন্নিত করতে হবে, সকল শিক্ষকদের যাতায়াত ভাতা দিতে হবে, ইএফটিতে বেতন হওয়া সত্বেও শিক্ষকরা সরকার ঘোষিত গৃহর্নিমাণ ঋণ পাচ্ছেন না তাই শিক্ষকদের শর্তবিহীন গৃহনির্মাণ ঋণ দিতে হবে।

শিক্ষকদের দাবিগুলোর মধ্যে আরও আছে, বিদ্যালয়ে স্লিপ ও সরকারি অন্যান্য বরাদ্দের অর্থ প্রধান শিক্ষক ও এসএমসির সভাপতির যৌথ অ্যাকাউন্টে না দিয়ে প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক প্রতিনিধির যৌথ অ্যাকাউন্টে দিতে হবে, মাসিক সমন্বয় সভায় সহকারী শিক্ষক প্রতিনিধি উপস্থিত নিশ্চিত করতে হবে।

সভায় সংগঠনের জেলা, উপজেলা ও বিভাগের প্রতিনিধিগণ তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। খুলনা বিভাগের প্রতিনিধি মো. ইমরুল সাহেদ ডিপিএড প্রশিক্ষণার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলে বেতন কমে যায় এটা অমানবিক ও অযৌক্তিক, দ্রুত সমাধানের জন্য কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031390190124512