প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ শিশু বাংলা একটি বই পড়তে পারে না। এর মধ্যে রয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ১০ দশমিক ২৮ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী ও ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী, যার গড় দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর বাইরে ১৮ দশমিক ০৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাঁচটির মধ্যে কমপক্ষে চারটি শব্দ শনাক্ত করতে পারে আর ৬১ দশমিক ৯৫ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী এবং ৫৩ দশমিক ১৪ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী তিনটি বা তার কম ভুল উচ্চারণসহ একটি কাহিনি সাবলীলভাবে পড়তে পারে।
গণিতেও একই অবস্থা। এ বিষয়ে ১৩ দশমিক ৬২ শতাংশ শিশু এক অঙ্কবিশিষ্ট সংখ্যা শনাক্ত করতে পারে না। শুধু ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থী দুটি যোগ সমস্যার সমাধান করতে পারে। আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের দুটি বিয়োগ ও দুটি ভাগ সমস্যার সমাধান করতে পারে না পর্যায়ক্রমে ৭৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং ৯৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ শিশু। সব থেকে করুণ অবস্থা ইংরেজিতে। এ বিষয়ে ছেলে শিশুর মধ্যে ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং মেয়ে শিশুর মধ্যে ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের একটি বর্ণও পড়তে পারে না। ২৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ শিশু পাঁচটির মধ্যে কমপক্ষে চারটি ইংরেজি শব্দ শনাক্ত করতে পারে। আর ৮৪ দশমিক ১৫ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী এবং ৮২ দশমিক ৮৬ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী তিনটি বা তার কম ভুল উচ্চারণসহ একটি কাহিনি সাবলীলভাবে পড়তে পারে না।
আজ বুধবার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশনের আয়োজনে রাজধানীর মিরপুরের ইউরোপ বাংলাদেশের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত ‘শিক্ষার্থীদের শিখন স্তরের বর্তমান অবস্থা ও শিক্ষার গুণগত মান অর্জন’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে এই জরিপের ফল তুলে ধরা হয়। দা সাউথ এশিয়ান অ্যাসেসমেন্ট অ্যালায়েন্স কমিউনিকেশনস অ্যান্ড কোলাবোরেটিং ফর চেঞ্জ (ইওএল) প্রকল্পের মাধ্যমে ওয়েভ ফাউন্ডেশন খুলনা ও রাজশাহী জেলায় ৮৮টি গ্রামের ৭১টি বিদ্যালয়ে এবং ১ হাজার ৭৬০টি পরিবারের ১ হাজার ৫৩৩জন শিশুর ওপর সিটিজেন লেড অ্যাসেসমেন্ট নামক জরিপটি পরিচালনা করা হয়। শিক্ষার্থীদের (৫-১৬ বছর বয়সী) অভিগম্যতা পর্যালোচনা ও শিক্ষার গুণগত মান পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের মৌলিক পঠন ও গাণিতিক শিখন যাচাই করার জন্য এই জরিপ পরিচালনা করা হয় বলে দাবি করা হয়।
জরিপে অভিভাবকদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও যাচাই করা হয়। এতে দেখা গেছে, যেসব শিশুর পিতা-মাতার মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ছিল, তারা ভাষার দক্ষতার ক্ষেত্রে ভালো করেছে, তাদের তুলনায় স্বল্প শিক্ষিত পিতা-মাতার শিশুদের ভাষার দক্ষতা সন্তোষজনক ছিল না। যেসব শিশুর পিতা-মাতার মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ছিল, তাদের মধ্যে ৪৫৯টি শিশু বাংলায় এবং ১৯২টি শিশু ইংরেজিতে কাহিনি পড়তে পেরেছে। আর যেসব অভিভাবকের প্রাথমিক বা কম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল, তাদের শিশুদের মধ্যে মাত্র ২৩টি শিশু বাংলায় এবং ৭৮টি শিশু ইংরেজিতে অক্ষর শনাক্ত করতে পেরেছে।
এজাতীয় সংলাপে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বেশ কিছু সুপারিশ দেওয়া হয়। বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ৪ অনুসারে সবির জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং সবার সমান শিক্ষা লাভের সুযোগের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সব ছেলে ও মেয়ে যাতে কার্যকর, ফলপ্রসূ অবৈতনিক, সমতাভিত্তিক ও গুণগত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষালাভের সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করা। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উদ্যোগে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ওয়েভ ফাউন্ডেশনের ইওএল প্রকল্পের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলো—শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা; অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা; শিক্ষকদের ক্লাস পরিচালনায় নিয়মিতকরণে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা; শিক্ষার গুণগত মান অর্জনে শ্রেণির পড়া শ্রেণিতেই সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা; অবকাঠামোগত উন্নয়ন তথা পর্যাপ্ত ক্লাসরুম ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা; শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; শিক্ষকদের বেতনকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো; শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা; সময়োপযোগী পাঠ্যপুস্তকসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ তৈরি ও বিতরণ করা; স্কুল ফিডিং কার্যক্রম প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বিশেষ করে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় চালু করা এবং শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে নীতিনির্ধারক, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সব অংশীজনের মতামতের আলোকে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা।
ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক কানিজ ফাতেমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী, ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. এস এম জুলফিকার আলী প্রমুখ।