প্রাথমিকে থাকবেনা পরীক্ষাঃ হবেনা প্রশ্ন ফাঁস

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

“থাকবেনা বাঁশ-বাজবেনা বাঁশি” প্রবাদটি দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করছি। পরীক্ষা নামক যে বাঁশি নোট, গাইড, কোচিং মুখী, জ্ঞান নির্ভর না হয়ে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার বিশাল বাণিজ্য পরিণত করেছে সে বাঁশকে আজ ছুড়ে ফেলতে হবে। শিক্ষক অভিভাবক মিলে মিশে একাকার হয়ে পরীক্ষার্থী হাতে অগ্রিম প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন। শিশুটি চেয়ে চেয়ে দেখছে অনৈতিক কাজ । ঘৃনার পাশাপাশি সে বড় হয়ে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়বে। এই সমাপনী, জে.এস.সি বড় পাশ কতটুকু জ্ঞান অর্জন করছে ? এ বিষয়ে ভাবতে হবে! ফল প্রকাশের পর মিষ্টির ব্যবসায়ীছাড়া শিক্ষার্থীরা তেমন কোন লাভবান হচ্ছে না।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৫ম শ্রেনির সমাপনী পরীক্ষা বাতিলের সুপারিশটি দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২৭ জুন ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে মন্ত্রিপরিষদ সভায় উত্থাপন করেছিল। মন্ত্রিপরিষদে উক্ত প্রস্তাব অনুমোদন না করে ৫ম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা বহাল রেখেছেন। মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবে জানানো হয়, কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা বাতিল করে উপজেলা পর্যায়ে নেওয়া হলে মেধাবৃত্তির টাকা প্রদান করা যাবে।

কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা বাতিল করে উপজেলা ভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়া অনেকটা একই পানি শুধু পাত্র পরিবর্তন করার মতো। ১ম-৫ম শ্রেনির উপজেলাভিত্তিক পরীক্ষায় উপজেলা শিক্ষা অফিসে বছরে লাখ লাখ টাকা জমা হয়ে থাকে। উপজেলাভিত্তিক পরীক্ষা হলে মেধাবৃত্তির জন্য কোনো কোনো স্থানে দুর্নীতির আশংকা থাকতে পারে। এতে নোট-গাইড বই ও কোচিং সেন্টারের ও পরীক্ষা বাণিজ্যকরণের ব্যাপকতা মোটেই হ্রাস পাবে না। বরং প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশংকা থেকেই যাবে। মন্ত্রিসভা বিষয়টি ব্যাপক পর্যালোচনার পর প্রস্তাব প্রেরণের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

বিকল্প উপজেলা পরীক্ষা নেয়া ছাড়া পরীক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে ব্যাপক পর্যালোচনা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। আশা করি শিক্ষাবিদ, জ্ঞানী-গুণীদের সমন্বয়ে মন্ত্রণালয় ৫ম শ্রেনির পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ করে বাস্তবভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করবে।দীর্ঘ সময়ের পরও এ নিয়ে কোন পর্যলোচনা দৃশ্যমান নয়। কারও কারও মতে, কঠোর শাসন ও পরীক্ষা ছাড়া শিশু শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জন ও বিকাশ সম্ভব নয়। এ ধারণা সঠিক নয়। লেখাপড়া ও পরীক্ষার ভীতি ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন শিশু মনোবিজ্ঞানীরা। শিশুরা

আনন্দদায়ক পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেলে সে শিক্ষা হবে অত্যন্তফলপ্রসূ। তাই একনাগাড়ে ক্লাসের পরিবর্তে ফাঁকে ফাঁকে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি খেলাধুলা, অংকন ও বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে সে শিক্ষা হবে আনন্দদায়ক ও অধিকতর কার্যকর। পাঠের প্রয়োজনে দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করা বার্ষিক পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। মৌলিক একাডেমির প্রশ্নপত্রের মানবণ্টন না করে সব শ্রেণির জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রশ্নপুস্তিকা প্রণয়ন করা উচিত। প্রশ্নপুস্তিকায় যাতে শিক্ষার্থীর সব জ্ঞান যাচাই হয় এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এ প্রশ্নপুস্তিকা অনুসরণ করে শিক্ষক প্রতিদিন পাঠের মাঝে বা শেষে, অধ্যায় বা গল্প পাঠের শেষে মৌখিক বা লিখিত মূল্যায়ন করবেন। দুর্বল বা অনুপস্থিত শিশুর ক্ষেত্রে বিশেষ পাঠের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করাবেন।

পাঠ্যবই হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পাঠবইয়ে যোগ্যতা ভিত্তিক প্রশ্ন, রচনা, প্যারাগ্রাফমুক্ত ও পাঠ সংশ্লিষ্ট ব্যাকরণ থাকা প্রয়োজন। বহুনির্বাচনী প্রশ্ন হ্রাস এবং শিশুর জন্য নিজে নিজে পাঠ্যবই দেখে প্রশ্ন তৈরি ও উত্তর লেখার সুযোগ থাকতে হবে। বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক, ফটোস্ট্যাট মেশিন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ৫ম শ্রেনির সমাপনী পরীক্ষা বন্ধ হলে নোট-গাইড, কোচিং সেন্টারের ব্যাপকতা কিছুটা হলেও কমবে। শিশুকে নিয়ে কোচিং সেন্টারে দৌড়ঝাপ, পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন, রচনা-প্যারাগ্রাফের খোঁজে একাধিক প্রকাশনীর বই কেনা থেকে অভিভাবকরা মুক্তি পাবেন ।

বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি অনেকটা হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসার মতো। ডিগ্রিবিহীন ডাক্তার যেমন লক্ষণ দেখে বা শুনে ওষুধ দিয়ে থাকেন, তেমনি বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতেও অধ্যায় বা পুরো বই থেকে কতিপয় প্রশ্ন দিয়ে শিক্ষার্থীর জ্ঞান যাচাই করা হয়। হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসায় যেমন অনেক ক্ষেত্রে রোগীর দেহে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, তেমনি বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে জিপিএ-৫ পেয়েও শিক্ষার্থীদের নানা ক্ষেত্রে হোঁচট খেতে হয়। ওষুধ খেয়ে অসুস্থ থাকা যেমন প্রকৃত চিকিৎসা নয়; তেমনি জ্ঞান অর্জন ছাড়া পাস কোনো কার্যকর শিক্ষা নয়। দেহের সব অঙ্গ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিপূর্ণ চিকিৎসা পেয়ে রোগী যেমন সুস্থ জীবনযাপন লাভ করতে পারে, শিক্ষার্থীও তেমনি তার সার্বিক কর্মকান্ড পরীক্ষার মাধ্যমে আদর্শ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এছাড়াও পরীক্ষা অনুষ্ঠানের ছয় দিন সহ বিশাল কর্মযজ্ঞে শিক্ষকরা ব্যস্থ থাকায় পুরো নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে শিক্ষার্থীরা অনেকটা শিক্ষকদের নাগাল পায় না।

বর্তমান পরীক্ষা ব্যবস্থায় শুধু লিখিতভাবে খানিকটা জ্ঞান যাচাই করা হয়। স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রশ্ন পুস্তিকার মাধ্যমে লিখিত মূল্যায়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থীর বাহ্যিক জ্ঞানও যাচাই করতে হবে। যেমন রিডিং স্কিল, বিদ্যালয়ে সময়মতো আগমন-প্রস্থান, নখ-চুল-দাঁত নিয়মিত পরীক্ষা করা। বাথরুম ব্যবহার, জাতীয় দিবসের কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ, নিয়মিত সমাবেশে যোগদান, জাতীয় ইতিহাস তথা বাঙালি সংস্কৃতি এবং নিজধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান ও ধর্ম পালন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যাচাই, নিজের কাজ নিজে করে কি-না, পাঠ্যবইয়ের বাইরে পত্র-পত্রিকা, গল্পের বই পড়ার অভ্যাস গঠন ইত্যাদি। এক কথায়, শিক্ষার্থীর লিখিত মূল্যায়নের পাশাপাশি সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অন্য সব গুণাবলী অর্জনে সুব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কার্যকর পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করার মাধ্যমে এক্ষেত্রে সব চ্যালেঞ্জ দূর করতে প্রয়োজন। মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ কিন্ডারগার্টের ও বেসরকারি স্কুলে শুধু মাত্র একটি পরীক্ষা বহাল রাখার যুক্তিকতা নিয়ে সকলে ভাববেন বলে আশাবাদী। পর্যাপ্ত শিক্ষক, শিক্ষকদের ১ম শ্রেনির মর্যাদা, বেতন কাঠামো, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, মূল্যায়নের জন্য ফটোস্ট্যাট মেশিন, কাগজসহ সমুদয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীর সার্বিক মূল্যায়নে ব্যর্থ শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর শিক্ষা বা মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টিকারী যত বড় ক্ষমতাবানই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আগামী প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আদর্শ মূল্যায়ন ব্যবস্থার বিকল্প নেই। বাণিজ্যভিত্তিক পরীক্ষা ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটুক। মেধাবৃত্তি দেয়ার নামে যাতে আগের মতো পঞ্চম শ্রেণির থানা-উপজেলাভিত্তিক পরীক্ষায় নোট-গাইড, কোচিং ব্যবসার প্রসার , প্রশ্ন ফাঁস, পরীক্ষা বাণিজ্য না হয় সেদিকে সবাইকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। শিক্ষাবিদ, শিশু মনোবিজ্ঞানী, সরকার তথা সংশ্লিষ্টদের দলমত নির্বিশেষে শিক্ষাক্ষেত্রের অনিয়ম, দুর্নীতি মুক্ত করার পাশাপাশি আগামী প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুললে এগিয়ে আসতে হবে।

মো. সিদ্দিকুর রহমান : আহ্বায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম
সম্পাদকীয় উপদেষ্টা “দৈনিক শিক্ষ ডটকম”

[email protected]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052499771118164