প্রাথমিকে পদোন্নতি প্রসঙ্গে

অলোক আচার্য |

চাকরিতে পদোন্নতি একটি কাঙ্ক্ষিত বিষয়। প্রত্যেকেই চায় তার যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় পর পদোন্নতি পেতে। অথচ প্রাথমিকে যেনো পদোন্নতি একটি দুরাশা মাত্র। চাকরিকাল শেষের দিকেও পদোন্নতি  বঞ্চিত প্রাথমিকের অসংখ্য শিক্ষক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্র অনুযায়ী, ১৫ বছরেও পদোন্নতি পাননি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষক। সিদ্ধান্ত হলেও সৃষ্টি হয়নি সিনিয়র শিক্ষক পদ। পাশাপাশি গ্রেড বৈষম্য দূর না হওয়ায় চরম অসন্তুষ্ট শিক্ষকেরা। শিক্ষা গবেষকেরা বলছেন, এ অবস্থা চললে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে না। সত্যি কথা হলো, গত কয়েক বছরে প্রাথমিকে বহু মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষক হিসেবে এসেছেন। কিন্তু তাদের অনেককেই ধরে রাখা যায়নি। কারণ, মেধাবীদের ধরে রাখার মতো একটি বেতন কাঠামো, পদন্নোতির সম্ভাবনা এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় তারা অন্য চাকরিতে চলে গেছেন। অথচ মেধাবীদেরও এই খাতে সবচেয়ে বেশি দরকার। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার। এর মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি বিদ্যালয়েই প্রধান শিক্ষক পদ খালি রয়েছে। 

সবশেষ ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর পর ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে গ্রেডেশন তালিকা করে কিছু সিনিয়র শিক্ষকদের চলতি দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এরপর গত ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের শেষে কিছু উপজেলায় পদোন্নতি দেয়া হলেও মামলার কারণে আবার পদোন্নতি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে প্রায় ১৫ বছর ধরে পদোন্নতির দিতে না পারায় দেশের অর্ধেকটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদ শূন্য। এক্ষেত্রে বলা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা মামলাজটেও আটকে আছে অনেকটা। কবে নাগাদ এই মামলাজটের অবসান ঘটবে তারও কোনো ঠিক নেই। যেসব শিক্ষক এতোদিন প্রধান শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন গুণছিলো মামলাজটে তাদের সেই স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়েছে। অনেকেই হয়তো অবসরেও চলে যাবেন। অথচ চাকরিতে পদোন্নতি র স্বপ্ন সকলেই দেখে।  সহকারী শিক্ষকরা এখন ১৩তম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন।

এর আগে যখন সহকারী শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন হিসেবে ১৪ ও ১৫তম গ্রেডে বেতন পেতেন তখনো প্রধান শিক্ষকেরা ১১তম গ্রেডে ছিলেন। এখনো তাই পাচ্ছেন। শোনা গিয়েছিলো এখানে সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। এই শিক্ষকেরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীই রয়ে গেলেন। দেশে তিন লাখেরও বেশি সহকারী শিক্ষক প্রাথমিক শিক্ষায় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এসব শিক্ষকের বেশির ভাগই অনার্স, মাস্টার্স যোগ্যতা সম্পন্ন। এখন এই উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৩তম গ্রেডে বেতন পাওয়াটা শিক্ষকদের জন্য বৈষম্যের সমান। যদিও কেউ বলেন, এই মাপকাঠিতে শিক্ষকদের বিবেচনা করা উচিত না। তবে এটা মনে হয় এই যুগে ঠিক না। তাহলে আলাদা একটি বেতন কাঠামো নির্ধারণের দাবি সামনে চলে আসে। সেটাও কি কোনোদিন বাস্তবায়িত হবে? কথা তো ছিলো।

প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শিক্ষকদের জীবন। এই মানুষগুলোর হাতেই শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন নির্ভর করে। আর এই কাজটা করেন প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকেরা মিলিতভাবে। শিক্ষা উপকরণ, উপাদান বা পদ্ধতি সবকিছুর সফলতা নির্ভর করে শিক্ষকদের ওপর। ফলে তাদের জীবনযাত্রার দিকে লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। সেক্ষেত্রে প্রথমেই আসে তাদের প্রাপ্ত গ্রেডের প্রসঙ্গ। একথা ঠিক যে তারা যখন শিক্ষকতা পেশায় আসছেন তখন তা দেখে, বুঝে তারপরেই আসছেন। আমরা যে চাই দেশের মেধাবী সন্তানরা শিক্ষকতায় বিশেষ করে শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর প্রাথমিকে আসুক তারা কেনো অন্য চাকরি ছেড়ে এখানে নিজের মেধা ও শ্রম দেবেন? এই প্রশ্নটি করা বাঞ্ছনীয়। যেখানে সুযোগ বেশি তারাও সেখানেই যেতে চাইবেন। আর যদি অন্যান্য চাকরির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড দেয়া হয় তখন তুলনামূলক বিবেচনায় মেধাবীরা ঠিকই প্রাথমিক শিক্ষায় যোগদান করবে। শিক্ষাকে উন্নত করতে হলে প্রাথমিক শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। শুধু টকশোতে এবং বিভিন্ন বক্তৃতায় প্রাথমিক শিক্ষা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে তুলে ধরলেই হবে না। এখানে যারা আছেন তাদেরও সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার। কারণ, এই শিক্ষা হলো ভিত্তি। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং জীবন ব্যবস্থায় শিক্ষকদের এই আয় সামান্যই। আর সেই প্রশ্নে যতোটুকু জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের শিক্ষকরা সবচেয়ে কম বেতন পান। আর আয় হলো সমাজরে সম্মানের মাপকাঠি। এটাই বাস্তবতা। ফলে প্রশ্নটা সম্মানেরও। এক ধরনের কষ্ট শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন আশা করে। শিক্ষকদের কর্মচারী রেখে দেশ কীভাবে এগিয়ে যাবে? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের ভিআইপি মর্যাদা দেয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষকদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে এদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় বহু সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। 

গ্রেড বৈষম্য দূর করে সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড দিয়ে করার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। একমাত্র প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরাই গ্রেডের দিকে এতো পেছনে রয়েছে। এই পদোন্নতি  এবং গ্রেড দুটি বিষয় এগিয়ে নেয়া সময়ের দাবি। সেটা করতে হলে মামলাজট সরাতে হবে সবার আগে। কেনো শিক্ষকেরা সর্বোচ্চ যোগ্যতাধারী হয়েও দশম গ্রেডে বেতন পাবেন না? তাদের দুর্বলতা কোথায়। প্রশ্ন হলো যোগ্যতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়নের। বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সময় এই ভিন্নতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এমনকি মাধ্যমিকে একজন সিনিয়র শিক্ষক এবং প্রাথমিকের একজন সিনিয়র শিক্ষকের ভেতর এবং একই যোগ্যতায় অন্য কোনো যোগ্যতার মধ্যে এই পার্থক্য বেশ চোখে লাগে। কোনো নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টর্স করা একজন মেধাবী ছাত্রছাত্রী কেনো স্বেচ্ছায় প্রাথমিকে চাকরি করবেন? যদি তাকে সেখানে যোগ্য সম্মান দেয়া না হয়। তাকে কেনো তৃতীয় শ্রেণির চাকরিতে যোগ দিতে হবে? মুখে যতোই বলি প্রাথমিকেই মেধাবীদের আনতে হবে। কিন্তু তারা কেনো আসবে? সবকিছুর সঙ্গে যদি আধুনিকায়ন করতেই হয় তবে এখানেও পরিবর্তন করতে হবে। এই ক্ষেত্রে যারা সর্বোচ্চ যোগ্যতাধারী তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা জরুরি। এখন প্রাথমিকে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ডিগ্রি পাস করা হয়েছে। এরা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং মেধাবী। একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় অন্য চাকরিতে ১০ম গ্রেড পেলে প্রাথমিক শিক্ষকদেরও তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষাই আমদের লক্ষ্য। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে যোগ্যতার মাপকাঠি সকল ক্ষেত্রে এক করতে হবে। একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে যখন যোগদান করেন তখন তাদের ভেতর পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক বা সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে বা তার থেকেও বড় পদে চাকরির আশা করতে পারেন। কারণ, অন্য সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ যতোটা রয়েছে এখানে ততোটা নেই। 

সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকে উন্নীত হলেও সেই প্রক্রিয়াও খুব দীর্ঘ। একজন শিক্ষক সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর যেনো নির্দিষ্ট সময় পর প্রধান শিক্ষক এবং কমপক্ষে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পর্যন্ত যেতে পারেন সেপথ সুগম করতে হবে। এতে যা হবে তা হলো চাকরির প্রতি দায়িত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং একটি লক্ষ্যে অগ্রসর হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর এ কথা সবাই স্বীকার করেন। সেক্ষেত্রে এই ক্ষেত্রে যে অসংগতিগুলো রয়েছে তা দূর করতে হবে। শিক্ষকদের চাকরির সন্তুষ্টি অর্জন ও তাদের কষ্টের জায়গাগুলোতে পর্যায়ক্রমে পূর্ণ করতে হবে। মেধাবী শিক্ষক টানতে শিক্ষকদের গ্রেড অন্য চাকরির সঙ্গে সামাঞ্জস্য করা, পদোন্নতি দেয়া-বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। এটা এখন সময়ের দাবি। 

একজন সহকারী শিক্ষক যেনো তার জীবনের একটি পর্যায়ে তার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক বা সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং সেখান থেকে আরো বড় পদে যেতে পারেন সে পথ সুগম করতে হবে। তবে সবার আগে বেতন বৈষম্য দূর করতে হবে।                                                                                                                        
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়মমাফিকভাবে জানানোর আহ্বান মাহফুজ আলমের - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়মমাফিকভাবে জানানোর আহ্বান মাহফুজ আলমের জামি’আ মাদরাসা দখলমুক্ত চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা - dainik shiksha জামি’আ মাদরাসা দখলমুক্ত চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা ৭ কলেজ নিয়ে পরিকল্পনা জানালেন শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha ৭ কলেজ নিয়ে পরিকল্পনা জানালেন শিক্ষা উপদেষ্টা ই-রিকুইজিশনের সংশোধন অপশন চালু - dainik shiksha ই-রিকুইজিশনের সংশোধন অপশন চালু পদোন্নতি নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিলো ইউজিসি - dainik shiksha পদোন্নতি নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিলো ইউজিসি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা ছাত্রাবাস খোলার দাবিতে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ছাত্রাবাস খোলার দাবিতে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ট্রাম্প প্রশাসনে শিক্ষামন্ত্রী হচ্ছেন লিন্ডা ম্যাকমোহন - dainik shiksha ট্রাম্প প্রশাসনে শিক্ষামন্ত্রী হচ্ছেন লিন্ডা ম্যাকমোহন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030250549316406