প্রাথমিক শিক্ষার আর্তনাদ

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষার্থীর সংকটে অস্তিত্ব বিলীন হতে চলছে। এ সংকটের অন্যতম চ্যালেঞ্জ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অধিকাংশ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে প্রাথমিকের শাখা খোলা, যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেনসহ ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, একমাত্র সরকারি প্রাথমিকে মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা। এ প্রেক্ষাপটে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংকট মুক্ত করার প্রয়াসে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করা হলো।

উচ্চ বিদ্যালয়সহ কলেজের প্রাথমিক শাখা বিলুপ্তকরণ: বাংলাদেশে ২টি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিলো। একটি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুলাই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদাকে সভাপতি করে, আরেকটি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে সভাপতি করে গঠিত জাতীয় শিক্ষানীতি। যা সর্বজন স্বীকৃতি লাভ করেছিলো। ২টি শিক্ষানীতিই তৃণমূল মানুষের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ প্রসারে, অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত নির্ধারণ করেছিলেন। অথচ ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে শাহাদাত বরণের ফলে স্বাধীনতার পরবর্তী শিক্ষা কমিশন আলোর মুখ দেখতে পারেনি। একই ধারাবাহিকতায় ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাব মোতাবেক ৭২৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এ যেনো সাধারণ মানুষের সন্তানদের ৮ম  শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা গ্রহণের খানিকটা আলোর উপহাস। তৎকালীন ৮ম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা নেয়ার প্রাথমিকের মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতাও ভেসে ওঠে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে প্রাথমিকের আলাদা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরের দাবি নিয়ে সংগ্রাম করেছিলাম।

স্বপ্ন ছিলো প্রাথমিকের আলাদা ক্যাডার সার্ভিস হবে। প্রাথমিকের তরুণ, মেধাবী,  প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পদোন্নতি পেয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান নিয়ে সমৃদ্ধ করবে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষা। স্বাধীনতার ৫২ বছরও সে স্বপ্ন নিয়ে মন্ত্রী, সচিব,  মহাপরিচালকসহ কারো ভাবনায় দৃশ্যমান হয়নি। জাতীয় শিক্ষানীতিকে উপেক্ষা করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নভেম্বর মাস থেকে উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজের প্রাথমিক শাখায় ভর্তির কার্যক্রম চলে আসছে। পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন ও ইবতেদায়ি মাদরাসায় উৎসবমুখর পরিবেশে ভর্তির কার্যক্রম চলছে। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে মা-বাবা হারা এতিম অনাথদের অনেকটা হোমভিজিট বা বস্তিতে খোঁজখবর নিয়ে অনেকটা টেনে এনে ভর্তি করা হয়। দরিদ্রতার কষাঘাতে তাদের উপস্থিতির হার থাকে অতি নগণ্য। বর্তমান সরকারের আমলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো শিশুবান্ধব, অনেকটা শিশুর স্বর্গ। অপরদিকে রয়েছে মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত ও শিশু শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকমণ্ডলী। রয়েছে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ নানা ধরনের জাতীয় প্রতিযোগিতা। উপবৃত্তি, মিড-ডে মিলসহ অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা। তা সত্ত্বেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ট্রেনিংবিহীন শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে উৎসাহিত করা হচ্ছে শিশু শিক্ষা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিশুর শারীরিক, মানসিক বিকাশ সাধনের প্রয়াসে শিশু শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রাথমিক শিক্ষা বিলুপ্তসহ তৃণমূল থেকে প্রশিক্ষণলব্ধ জনবল নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নেয়ার প্রয়াসে স্বতন্ত্র  প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিসের গুরুত্ব অপরিসীম। 

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মূল্যায়ন ব্যবস্থা: পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অভ্যস্ত বাংলাদেশের অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সব নাগরিক। পরীক্ষার পরিবর্তে মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিয়ে অজ্ঞতা রয়েছে এখনো আমাদের শিক্ষক সমাজের। সবচেয়ে বেশি অজ্ঞতা দৃশ্যমান নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারের মাঝে।

তাদের তৃণমূলের অভিজ্ঞতা নেই বলে পরীক্ষা তথা মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে এক সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ৪০ শতাংশ ধারাবাহিক মূল্যায়নের পাশাপাশি ৬০ শতাংশ সামষ্টিক লিখিত মূল্যায়ন ছিলো। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে শতভাগ পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। প্রশ্নপত্রের শিরোনামে প্রান্তিক মূল্যায়ন দেয়া হচ্ছে। যা প্রকৃত মূল্যায়ন নয়। এ মূল্যায়ন সাবেক লিখিত পরীক্ষা। এর ফলে শিক্ষার্থীর সার্বিক শোনা, বলা, পড়া, লেখার যোগ্যতা যাচাইসহ জ্ঞান অর্জন হচ্ছে না। শিক্ষার্থী যাতে পাঠের প্রতিটি শব্দ বাক্য শিখে ৪টি যোগ্যতা অর্জন করতে পারে সে দিকে গুরুত্ব  দিতে হবে। মূল্যায়ন ব্যবস্থার লক্ষ্য হবে সার্বিক জ্ঞান অর্জন। বেশি বেশি নম্বর প্রাপ্তি নয়। মূল্যায়ন হবে প্রতি পিরিয়ডে বা প্রতি পাঠে, প্রতিটি গল্প বা অধ্যায়ের শেষে। মূল্যায়ন  শিক্ষার্থীর বলার ও লেখার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মেধা বিকাশসহ শিক্ষার্থী নিজে নিজে বলতে ও লিখার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। প্রায় প্রতিটি পাঠ থেকে শিক্ষার্থীকে রচনা অনুচ্ছেদ বা প্যারাগ্রাফ লেখা ও বলার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। আমাদের রচনা প্যারাগ্রাফ লেখার পদ্ধতি পরিবর্তন প্রয়োজন। অতীত থেকে বর্তমানে রচনা বই বইয়ের রচনা মুখস্থ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতায় বমি করিয়ে অনেক নম্বর পেয়ে খুশিতে সবাই আত্মহারা  হয়ে পড়ে। কবিগুরু তার লেখায় বলে গেছেন, এ বমি করার চেয়ে দেখে দেখে লেখা অতি উত্তম। রচনা শব্দের অর্থ ‘রচ তুমি আপন মনে’। সত্যিই কি আমাদের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে রচনা লেখার অভ্যাস করায়? ২য় শ্রেণির থেকে তৃতীয় প্রান্তিক থেকে পরিবেশের বিভিন্ন জিনিস দেখে বাক্য তৈরি করবে এবং লিখবে। এভাবে পরিবেশের নানা জিনিস ঘটনা, বিভিন্ন জাতীয় দিবস, রমজান মাস, ঈদ সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতার কেন্দ্রিক রচনা বলতে ও লেখতে পারবে। পরিবেশের নানা ঘটনা উল্লেখযোগ্য স্থান নানা জিনিস নিয়ে কেনো আমরা শিক্ষার্থীর নিজে বলা ও লেখার দক্ষতা অর্জন করাই না।

মূল্যায়নের কাঙ্খিত সফলতা অর্জনে চ্যালেঞ্জ দূর না করে, এ ব্যবস্থা শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর চাপিয়ে দেয়া যথার্থ নয়। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ম ও ২য় শ্রেণির মতো ক, খ, গ, এর মূল্যায়নের অকার্যকর হতে বাধ্য। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্তসহ সুনাম নষ্ট হবে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষা। এ প্রেক্ষাপটে কতিপয় সুপারিশ অতি শিগগিরই ব্যস্তবায়নের প্রত্যাশা করছি। 

১. দেশের সব শিশুর এক ও অভিন্ন মূল্যায়ন ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন। অনতিবিলম্বে সব কিন্ডারগার্টেন, ইবতেদায়ি মাদরাসা, হাইস্কুলসহ কলেজের প্রাথমিক শাখায় অভিন্ন (বই মূল্যায়ন ও সময়সূচি) নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
২. প্রাথমিকের ১:৩০ শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকের শূন্যপদ ক্ষণিকের জন্যও কাম্য নয়। এর জন্য নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের গাফিলতির জন্য কঠোর জবাবদিহীতার আওতায় আনতে হবে। ব্যাংকের কর্মচারীদের মতো কর্মকর্তা, শিক্ষক সবাই যেনো তাদের কাজের এর হিসাব মিলিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। শিক্ষার্থীর সফলতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
৩. শিক্ষকদের সব পাঠদান বহির্ভূত কাজ থেকে অব্যাহতি দেয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। এ লক্ষ্যে এক বা একাধিক অফিস সহকারী নিয়োগ করা প্রয়োজন। ঘন ঘন কমিটির মিটিং যা অনেকটা কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ যা বাস্তব বিবর্জিত। মিটিংয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার চ্যালেঞ্জের দূরীকরণে ও সমাধানের ।
৪. সফল মূল্যায়ন ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য দৈনিক ৩০/৪০ মিনিটের ৬/৭টা পিরিয়ড কোনো অবস্থাতে কাম্য নয়। প্রতিটি পিরিয়ড হবে কমপক্ষে এক ঘণ্টা, দৈনিক চারটার বেশি পিরিয়ড হলে মূল্যায়ন ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। সবার আন্তরিকতা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন শিক্ষক, অভিভাবক ম্যানেজিং কমিটিসহ মন্ত্রী পর্যন্ত কঠোর জবাবদিহিতা। 
৫. পাশাপাশি তৃণমূল থেকে মেধাবী, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ জনবল নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া। 

প্রাথমিকের সমস্য দূরীকরণে অভিজ্ঞ জনবলই পারে প্রাথমিক শিক্ষার আর্তনাদ দূর করতে। 

লেখক:  মো. সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি - dainik shiksha কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের - dainik shiksha কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক - dainik shiksha আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha অনির্দিষ্টকালের জন্য স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা শিক্ষা ব্যবস্থার অসঙ্গতি ও প্রয়োজনীয় সংস্কার - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থার অসঙ্গতি ও প্রয়োজনীয় সংস্কার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005781888961792