প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল দশা হাওরাঞ্চলে

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি |

সুনামগঞ্জের দুর্গম হাওরাঞ্চল হিসেবে খ্যাত ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলার ১৯৪ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১১ বিদ্যালয় চলছে শিক্ষার্থী সংকটে। ওই ১১ বিদ্যালয়ের প্রতিটিতেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ জনের নিচে। এছাড়াও পরিবারের অভাব গোছাতে হাওরে মাছ ধরাসহ বাবা-মায়ের সঙ্গে অন্যত্র বসবাস করায় প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই ঝরে পড়ছে অনেক শিশু।

এছাড়াও এক থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে একাধিক বিদ্যালয়, শিক্ষকদের পাঠদানে অবহেলা এবং নির্ধারিত সময়ে বিদ্যালয়ে না যাওয়া ও নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টা দুয়েক আগেই বিদ্যালয় ছুটি দেয়া, করোনা পরিস্থিতি, হাওরে ফসলহানি ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতির কারণে হাওরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দিনদিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। হাওরাঞ্চল হিসেবে খ্যাত ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলার কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরজমিন ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

ধর্মপাশা উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে প্রাক প্রাাথমিক শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ১৮ জন। এর মধ্যে প্রাক প্রাথমিকে ৪ জন, প্রথম শ্রেণিতে ২ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৭ জন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে ১ জন করে এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২৬ জন। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ জন, গত বছর এ সংখ্যা নেমেছিল ১৯ জনে। বিদ্যালয়টিতে ১৮ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ৬ জন শিক্ষক।

একই অবস্থা মধ্যনগর উপজেলার দরাপপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও। মাত্র ২ জন শিক্ষকের ওপর ভর করে ২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে এ বিদ্যালয়টির কার্যক্রম। এ বিদ্যালয়ে গত বছর ২৭ জন, এর আগের বছর ৩১ ও ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষার্থী ছিল ৩৪ জন।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যানুযায়ী ৫০ জনের নিচে শিক্ষার্থী আছে এমন বিদ্যালয়গুলো হলো- বালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৮, বাসাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪০ ও মাসকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়াও কলুমা মাছুয়াকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৪, ঢুলপুষি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩১, মাছুয়াকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৭, নগদাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪০, রাঙামাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪০, নওয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪৫, কাহালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।

শুধু ওই ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই নয় ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলা সদরসহ আশপাশের অনেক বিদ্যালয়ে দিনদিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমছে। গত বছর ধর্মপাশা ২নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৯৬ জন। এ বছর বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী কমেছে ১৬ জন। সরজমিন বিভিন্ন বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, কোনো কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতির সংখ্যা খুবই কম। এ সময় শিক্ষার্থীশূন্য শ্রেণিকক্ষও দেখতে পাওয়া যায়।

ধর্মপাশা উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নের বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, আমাদের এলাকায় অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে যেগুলো বিদ্যালয় খোলার সময়ের আধাঘণ্টা পর খোলা হয়, আবার ছুটি দেয়া হয় একঘণ্টা আগেই। ফলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে চরম বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে।

মধ্যনগর উপজেলার বাসিন্দা শিমুল মিয়া বলেন, পরিবারের অভাব গোছাতে অনেক শিশুই হাওরে মাছধরাসহ বাবা মায়ের সঙ্গে অন্যত্র বসবাস ও নানা কাজ করছে। ফলে দিনদিন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। একই উপজেলার বাসিন্দা বিল্লাল মিয়া বলেন, এক থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে একাধিক বিদ্যালয়, শিক্ষকদের পাঠদানে অবহেলা এবং নির্ধারিত সময়ে বিদ্যালয়ে না যাওয়া ও নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টা দুয়েক আগেই বিদ্যালয় ছুটি দেয়ার কারণে হাওরাঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থার এ বেহাল দশা।

ধর্মপাশা উপজেলার নিজগাবী গ্রামের বাসিন্দা সামছুল হক বলেন, হাওরে ফসলহানি, করোনা পরিস্থিতি এবং গেল বছরের ভয়াবহ বন্যার প্রভাব, সেই সঙ্গে এলাকার অধিকাংশ পরিবার দরিদ্র হওয়ার কারণে এবং এলাকায় কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় অনেক পরিবার কাজের জন্য এলাকা ছেড়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা অঞ্চলে বসবাস করার কারনে তাদের শিশুরা সেখানে অবস্থান করে। ফলে এখানকার অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট দেখা দিয়েছে।

মাসকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক মলয় চন্দ্র সরকার বলেন, গ্রামে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম থাকায় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কম। বালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক মুখলেছুর রহমান বলেন, বালিয়া গ্রামে মাত্র ৪২টি খানা রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা একেবারেই কম এবং যারা একটু সচেতন তারা তাদের সন্তানদের উপজেলা সদরের স্কুলে ভর্তি করে দেন। বাসাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক আব্দুল মন্নান বলেন, বাসাউড়া গ্রামে জন্মহার একেবারেই কম, ফলে এখানে শিক্ষার্থীও কম।

ঢুলপুষি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক শামিউল কিবরিয়া তালুকদার বলেন, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে আমার বিদ্যালয় পরিদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যালয়টির অবস্থান এমন জায়গায় যে, ভৌগোলিক কারণে এ বিদ্যালয় থেকে অন্য বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মার্জ করা হলে শিক্ষার্থীদের বর্ষা কিংবা হেমন্তে দূরের বিদ্যালয়ে যাতায়াত অত্যন্ত দুর্গম হয়ে যাবে।

ধর্মপাশা ২নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক নজমুল হায়দার বলেন, করোনাকালীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় এলাকায় অনেক মাদ্রাসা গড়ে ওঠেছে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী মাদরাসামুখি হয়েছে। বিদ্যালয় চালু হলেও দীর্ঘ বিরতির পর অনেক শিক্ষার্থী আর বিদ্যালয়ে ফিরেনি।

জানতে চাইলে ধর্মপাশা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মানবেন্দ্র দাস জানান, মূলত ওই বিদ্যালয়গুলোর এলাকায় জনসংখ্যা খুবই কম। শত চেষ্টা করলেও ওই বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। ৫০ বা তার কম শিক্ষার্থী রয়েছে এমন বিদ্যালয়ের তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ মার্জ করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন কিন্তু দুর্গম হাওর এলাকা হওয়ায় মার্জ করাও সম্ভব নয়। এখানে এক গ্রাম থেকে অন্যগ্রামে যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই দুর্গম।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
আইনের মারপ্যাঁচে অনিশ্চিত ১৯তম শিক্ষক নিবন্ধন - dainik shiksha আইনের মারপ্যাঁচে অনিশ্চিত ১৯তম শিক্ষক নিবন্ধন ‘ঢাবির ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু হচ্ছে শিগগিরই’ - dainik shiksha ‘ঢাবির ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু হচ্ছে শিগগিরই’ হাই-টেক পার্কের নাম হবে জেলার নামে: উপদেষ্টা নাহিদ - dainik shiksha হাই-টেক পার্কের নাম হবে জেলার নামে: উপদেষ্টা নাহিদ দীপু মনির নামে আরেক মামলা, আসামি ৬০০ - dainik shiksha দীপু মনির নামে আরেক মামলা, আসামি ৬০০ স্কুল-কলেজে বিশৃঙ্খলা : কোথাও জবরদস্তি কোথাও পালিয়ে থাকা - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বিশৃঙ্খলা : কোথাও জবরদস্তি কোথাও পালিয়ে থাকা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0046780109405518