সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় এগিয়ে রয়েছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। পিছিয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। তবে, সবচেয়ে পিছিয়ে সিলেট বিভাগের শিক্ষার্থীরা- এমনটি তথ্য প্রকাশ করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন-২০২২ এর জাতীয় প্রচারণা কৌশল শীর্ষক কর্মশালায় জরিপের এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
শনিবার (১৯ আগস্ট) কক্সবাজারের তারকা হোটেল লংবিচের সম্মেলন কক্ষে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের উদ্যোগে ইউনিসেফের সহযোগিতায় দিনব্যাপী এ কর্মশালা আয়োজন করা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) শাহ রেজওয়ান হায়াতের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহমেদ।
কর্মশালায় বক্তব্য রাখেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের চিফ অফ এডুকেশন দীপা শঙ্কর, ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ কাউন্সিলের শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা এবং ডেপুটি টিম লিডার মো. গোলাম কিবরিয়া।
কর্মশালায় জানানো হয়, প্রতি দুই বছর অন্তর জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন জরিপ চালানো হয়। ২০১৭ সালের পর করোনার কারণে ২০১৯ ও ২০২১ সালে জরিপ স্থগিত ছিল। কিন্তু পূর্বের ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে আবারো জরিপ চালানো হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে জরিপে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণীর গণিত এবং বাংলা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিভাগের পঞ্চম ও তৃতীয় শ্রেণীর ৫৪ হাজার ২৩২ জন শিক্ষার্থীর উপর চালানো জরিপে উঠে এসেছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ফল, মানসিক দক্ষতা, ঝড়ে পড়ারোধ, শিক্ষার্থীর অনুধাবন এবং কোন স্তরের প্রশ্নের উত্তর দানের দক্ষতা কত, সর্বোপরি তাদের সার্বিক ফলাফলের উপর মূল্যায়ন। জরিপে শিখন এবং সার্বিক ফলাফলে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা এগিয়ে রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ঢাকা এবং ময়মনসিংহ জেলার শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় এগিয়ে রয়েছে এবং সেই তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। তবে, সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে রয়েছে সিলেট বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
কর্মশালায় আরও জানানো হয়, জরিপে পড়ালেখার অগ্রগতি, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ারোধ, জ্ঞান ও অনুধাবন স্তরের প্রশ্ন বুঝার দক্ষতা অর্জনে বিভিন্ন সুপারিশ রয়েছে। এর মধ্যেই রয়েছে দেশব্যাপী শিক্ষক স্বল্পতা দূরীকরণে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম সম্পাদন, স্কুলে স্কুলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার নেতৃত্বে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সুপারভিশন কার্যক্রম বৃদ্ধি, প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের শ্রেণী কার্যক্রম আনন্দদায়ক করতে শ্রেণীকক্ষ সজ্জিতকরণ, ক্লাস্টার ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম জোরদার করাসহ গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ রয়েছে।
কর্মশালায় দেওয়া বক্তব্যে সচিব ফরিদ আহমেদ বলেন, দেশের প্রাথমিক শিক্ষার গুনগত মানবৃদ্ধিতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে গড়ে তোলা হচ্ছে শিশুবান্ধব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে। অভিভাবকরা বলার আগেই যেন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যেতে অভিভাবকদের বিরক্ত করেন, সেই মতোই গড়ে তোলা হচ্ছে শ্রেণী কক্ষ। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলাধুলার স্পেস রাখা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের খেলার মাঠ সম্প্রসারণ, সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঝরেপড়া রোধে শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা আবারো চালু হবে। দেড়শ উপজেলায় আগামী বছর থেকে ‘স্কুল মিল’ দেয়া হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আরও বলেন, প্রতিবছর ৬ হাজার শিক্ষক অবসর গ্রহণ করেন তাই- শিক্ষক সংকট আমাদের লেগেই থাকে। বুয়েটের মাধ্যমে নিয়োগ প্যানেল তৈরি করে দেশে শিক্ষক সংকট দূরীকরণে প্রতি ছয় মাস অন্তর শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম গ্রহণ করছে মন্ত্রণালয়। আগামী বছর থেকে এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ করা হবে।
সচিব ফরিদ আশা প্রকাশ করে বলেন, ২০২৬ সালে আমরা গ্রাজুয়েট হবো। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটির মাধ্যমে উন্নত ও সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ। প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করে যারা দেশের সহযোগিতায় ভূমিকা রাখবে তারা-ই দেশের স্মার্ট সিটিজেন হিসেবে গড়ে উঠবে। আজকের প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরাই হবেন আগামী দিনের স্মার্ট এবং প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন নাগরিক। ফলে তাদের হাতেই থাকবে স্মার্ট সোনার বাংলাদেশ। যেটি বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন।
২০১৭ সালের জরিপের চেয়ে ২০২২ সালের জরিপ ফলাফল নিম্নমুখী হবে বলে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু টেনে টুনে সমান সমান হয়েছি। ছেলেদের তুলনায় সব বিভাগে মেয়েরা এগুচ্ছে। এটা ভালো- নারী শিক্ষার হার বাড়ছে। তবে, ছেলেরা পিছিয়ে পড়াও উদ্বেগের। এভাবে পাশ হতে চায় না। সব বিষয়ে ছেলে-মেয়ে সমান্তরাল ভাবে মেধার স্বাক্ষর রেখে এগিয়ে যেতে চাই। যেসব বিভাগে আমরা পিছিয়ে আছি, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমান্তরাল ভাবে এগুনোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। শিক্ষকগণ আন্তরিক ও সৃজনশীল হলে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ক্রমে বাড়বে।
দেশে ১ লাখ ১৪ হাজার প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অর্ধলাখ এবতেদায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানসম্মত শিক্ষা প্রচারে ভূমিকা রাখছে। সর্বস্তরের শিশুরা যেন একই পদ্ধতিতে জ্ঞান অর্জন করতে পারে তার জন্য এবতেদায়ী মাদ্রাসা গুলোতেও উপবৃত্তি চালুর উদ্যোগ চলছে। ইতোমধ্যে বিদ্যমান প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ৮৫ শতাংশে নতুন ভবন গড়ে উঠেছে। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষার মানও বৃদ্ধি আশা করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহমেদ।
দিনব্যাপী কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিচালক শাহেনুর শাহিন খান। এতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার শিক্ষা বিভাগের শতাধিক কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ইউনিসেফর কর্মকর্তা, অস্ট্রেলিয়ান কাউন্সিল ফর এডুকেশনের কর্মকর্তা, বিভিন্ন শিক্ষাবিদ সাংবাদিকগণ অংশ নেন।