‘গরীবের কথা বাসি হলেই ফলে’-নামে একটি প্রবাদ আছে। শিক্ষানীতি-২০১০ আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার সুপারিশ করে। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তা পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। সরকার মাঝে মাঝে জোরেসোরেই প্রকাশ করতো যে, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হবেই। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে প্রথম থেকেই আমরা সন্দিহান ছিলাম। বাংলা ও ইংরেজি উভয় পত্রিকাতেই মতামত প্রকাশ করেছিলাম যে, আমরা প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করতে প্রস্তত নই। কিন্তু সরকার বাস্তবায়ন করবেই। কী ভাবে করবে কোন ব্যাখ্যা সরকার দেয়নি। অনেক শিক্ষাবিদ অনেকভাবে যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে এটি সম্ভব নয়। কিন্তু সমস্ত পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হল যে, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হবেই।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত বিদ্যালয়ের অনুমোদন, পরীক্ষা গ্রহণসহ অন্যান্য সকল প্রশাসনিক বিষয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে’ প্রেরণ করা হয়েছে অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হচ্ছেই। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ক’বছর আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, সারাদেশের পাঁচ হাজার নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দেখভালের দায়িত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে। কেউ নতুন শ্রেণি ও শাখা খোলা এবং শিক্ষক এমপিওভুক্তি বিষয়ে আবেদন করলে তা ওই মন্ত্রণালয় নিষ্পত্তি করবে। তবে বাস্তবে গত এক বছরে সেখান থেকে এ বিষয়ে কোন আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়নি। গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাস্তর এখনও যেহেতু চালু হয়নি তাই বিষয়টি তাদের এখতিয়ারভুক্ত নয়। এভাবে সারা দেশের নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় নিয়ে এক জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সরকার ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কথা বলেছিল, এখন আবার ২০২১ খ্রিস্টাব্দের কথা বলছে। সরকারি সিদ্ধান্তহীনতা ও বাস্তবায়নে জটিলতা বা বিলম্বের কারনে দেশের নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজগুলো আটকে আছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীও বলেছিলেন, ‘অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের সব কার্যক্রম আমাদের দেওয়া হয়েছে, আমরা এ কার্যক্রম শুরু করে দিলাম। এ জন্য সবার সহযোগিতা চাই।’ এটি এখন থেকে তের মাস আগের ঘটনা। কিন্তু ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে রণে ভঙ্গ দিয়ে বলা হলো প্রাথমিক শিক্ষা আপাতত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হচ্ছে না। আমাদের প্রশ্ন কবে হবে এবং আদৌ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা সম্ভব হবে কি না ?
শিক্ষানীতি ২০১০-এর ২ অধ্যায়-এর অনুচেছদ-১ এ প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ ও বাস্তবায়ন সম্পর্কে চারটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বৃদ্ধি করে আট বছর অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। এতে উল্লেখ করা হয় প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার নতুন কার্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক এবং শিক্ষক নির্দেশিকা প্রণয়ন করা, প্রাথমিক পর্যায়ে সকল শিক্ষকের জন্য শিক্ষাক্রম বিস্তারসহ শিক্ষণ-শেখানো কার্যক্রমের ওপর ফলপ্রসূ ব্যবস্থা গ্রহণ, শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাস এবং সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভৌত সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি এবং শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ানো । এই বিষয়গুলো অনুসরণ করে আট বছরব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষা ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ছেলে-মেয়ে, আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং জাতিসত্তা নির্বিশেষে পর্যায়ক্রমে দেশের সকল শিশুর জন্য নিশ্চিত করা উল্লেখযোগ্য। শিক্ষার নতুন কার্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক এবং শিক্ষক নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়তো দুই-তিন বছরে সম্ভব। তাও কিন্তু করা সম্ভব হয়নি।
সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভৌত কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যাই ৬৩ হাজার ৮৭৫টি, বেসরকারি পর্যায়েরগুলো মিলে এক লাখের অধিক। এতগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইনফ্রাস্ট্রাকচার পরিবর্তন করা চাট্টিখানি কথা নয় অথচ কোন বাজেটেই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য কোন আলাদা বরাদ্দের কথা আমরা শুনিনি। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সবাই নাকি প্রস্তত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে। আমাদের প্রশ্ন ছিল, তা কী ভাবে সম্ভব? এ ছাড়াও প্রচলিত দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় বিশ হাজারের মতো সাধারণ মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। সেখানকার শিক্ষকগন ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করেন। তারা কি প্রাথমিকের শিক্ষক হবেন?
যেসব কলেজিয়েট স্কুল রয়েছে যেগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ানো হয় সেখানকার শিক্ষকদের পদবী হচেছ প্রভাষক, সহকারি অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক। শিক্ষানীতির এই নিয়মে সেগুলো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হবে। তাহলে অবশ্যই শিক্ষকদের পদবী হবে সহকারি শিক্ষক, সিনিয়র শিক্ষক। কিন্তু তারা কি তা হতে চাইবেন? এসব প্রশ্নগুলো আমি রেখেছিলাম আমার পূর্ববর্তী লেখাগুলোতে। জাতীয় পর্যায়ে এ নিয়ে কথা, আলোচনা, সভা সেমিনার এবং সবার মুখে মুখে এগুলোর সমাধান থাকতে হবে। কারণ বিষয়টি খুব সহজ নয়। দেখলাম সরকার বা মন্ত্রণালয় এসব ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ। তবে মাঝে মাঝে দেখতাম সরকার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা উন্নীত করতে বদ্ধপরিকর। কোন যুক্তি, পরিবর্তনের মাইলস্টোন কিছুই ঠিক না করে শুধু বদ্ধপরিকর কথাটি বেমানান মনে হচিছল।
পাকিস্তান আমলে প্রাথমিক শিক্ষা ছিল চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। পঞ্চাশের দশকে তা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা হলো। তখন থেকেই অবশ্য প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার সুপারিশ এসেছে। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের শরিফ কমিশন পরবর্তী ১৫ বছরে অর্থাৎ সত্তর দশকের মাঝামাঝি নাগাদ পাকিস্তানে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার সুপারিশ করেছিল। ছাত্র-গণআন্দোলনের মুখে তা বাতিল হয়ে যায়। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের নূর খান কমিশন আলোর মুখই দেখতে পায়নি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কুদরত-ই-খুদা কমিশন ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে সে স্বপ্নও শীতনিদ্রায় চলে যায়। সমস্ত কমিশনগুলোর উপর পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলছি আমরা কি আসলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য প্রস্তত ছিলাম?
এটি সত্যি যে, পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। যেমন- আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। অস্ট্রেলিয়াতেও অবশ্য অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। চীন, শ্রীলংকা, মিসর, থাইল্যান্ড ও জাপানে তা ছয় বছর মেয়াদি। আলজেরিয়া, ব্রাজিল, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, সুইডেনে প্রাথমিক শিক্ষা নবম শ্রেণি পর্যন্ত। পাকিস্তানে পাঁচ বছর মেয়াদি। আমাদের দেশেও সেই স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা। সেটি একটু বাড়ানো প্রয়োজন ছিল কিন্তু একেবারে তিন বছর বাড়ানোর প্রস্তাবের ফলে একেবারেই বাড়ানো সম্ভব হয়নি। যতগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে সবগুলোই বিরোধিতার মুখে পড়ে এবং ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ‘কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন’কে তেমন কোন বাধার মুখে পড়তে হয়নি। সরকারও বদল হয়নি এমনকি শিক্ষামন্ত্রীও একই ব্যক্তি। তারপরেও গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলোনা। প্রাথমিক শিক্ষাস্তর ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার প্রতিশ্রুতি ছিল কিন্তু বাস্তবায়ন হলো না। অর্থাৎ বুঝাই যাচেছ বিষয়টি আমাদের প্রেক্ষাপটে বাস্তব নয়।
আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিচিত্র ধরণের। কোথাও নার্সারি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, কোথাও তৃতীয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, কোথাও ষষ্ঠ থেকে ডিগ্রী , আবার কোথাও উচ্চ মাধ্যমিক থেকে মাস্টার্স। এসব গুলোকে ভেঙে নতুনভাবে বিন্যস্ত করা চাট্টিখানি কথা নয়। সবগুলোই প্রয়োজনের ও বাস্তবতার তাগিদেই গড়ে উঠেছে। আর সেগুলো পরিবর্তন করতে হলে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা কিছুই হয়নি। বিষয়টি শুধু চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপার নয়, সেটি আমাদের বুঝতে হবে।
সবকিছু বিবেচনায় নিলে আমাদের দেশে আসলে পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণ করা হলে সেটি আমার মনে হয় বেশি বাস্তবসম্মত হবে কারণ তাতে নতুন করে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানের ইনফ্রাস্ট্রাকচার খুব একটি বানাতে হবেনা, শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও খুব একটি পরিবর্তন প্রয়োজন হবে না। সরকার তাহলে প্রাথমিকের মান নিয়ন্ত্রণের ওপর যথেষ্ট সময় দিতে পারবে। আমরা প্রাথমিক শিক্ষা আট বছর করি অথচ মান যদি বর্তমান পর্যায়েই থাকে তাহলে তাতে তেমন কোন লাভ হবে না। মান তাতে আরও কমে যাবে। ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করার পর একজন শিক্ষার্থীর যতগুলো প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করার কথা সে বিষয়টির ওপর জোর দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত করার কথা সরকার ভেবে দেখতে পারে।
মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্য্রাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক।