বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় পাসের হার খুবই সন্তোষজনক। তারপরও শিক্ষার মান নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই। প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি। সে হিসেবে শিক্ষার মানোন্নয়নে কিছু সংযোজন আর কিছু বিয়োজনেরও প্রয়োজনবোধ করছি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনতেই এই প্রয়াস। শনিবার (৭ মার্চ) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, প্রথমত, দ্রুত ভাষা শিক্ষার জন্য প্রাক প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির স্তরটি খুবই উত্তম। এদের বই দেখে পড়া নিশ্চিত করতে টেক্সট বুককে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এ সময়ে শিশু শিক্ষার্থীরা দ্রুত ভাষা রপ্ত করতে পারে। পৃথক ইংলিশ শিক্ষক দিয়ে ইংলিশ স্পিকিংও রপ্ত করে পরবর্তী শ্রেণিতে তা চালু করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র শতভাগ যোগ্যতাভিত্তিক। যদি চল্লিশ শতাংশ প্রশ্ন সরাসরি টেক্সট বুকের অনুশীলনী থেকে ভালো শিক্ষার্থীদের জন্য, অধিকতর ভালো শিক্ষার্থীদের জন্য চল্লিশ শতাংশ পাঠ্যবই থেকে এবং সর্বোত্তম শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ শতাংশ সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রণীত হয়, তাহলে গাইডের পেছনে দৌড়াতে হবে না।
তৃতীয়ত, আনসিন প্যাসেজগুলো অপেক্ষাকৃত নিচের ক্লাস থেকে, সহপাঠক্রমিক (গল্পের বই) থেকে দেওয়া গেলে গাইড বইয়ের আর প্রয়োজন পড়বে না।
চতুর্থত, ইংরেজির জন্য সহজ গ্রামার বই প্রণয়ন করে ট্রানস্লেশন রেখে পরীক্ষায় ভালো, অধিকতর ভালো, সর্বোত্তম ভালো পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য মুক্ত হাতের লেখা (নিজ পরিবার, দেশ, জেলা) চালু করা যেতে পারে। ট্রানস্লেশন দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করবে।
পঞ্চমত, গণিতের চার নিয়মের সমস্যাগুলো পাঠ্যবইয়ের ৭০ ভাগ এবং পরীক্ষায় ৭০ শতাংশ প্রশ্ন প্রণীত হলে ভালো হয়। অন্যান্য বিষয় (ভগ্নাংশ, দশমিক ভগ্নাংশ, জ্যামিতি) প্রাইমারিতে সীমিত আকারে থাকলে গণিত-ভীতি দূর হবে। পরীক্ষায় ৫০ শতাংশ প্রশ্ন সরাসরি পাঠ্যবইয়ের অনুশীলন থেকে, ৩০ শতাংশ পাঠ্যবই থেকে এবং ২০ শতাংশ সর্বোত্তম শিক্ষার্থীদের জন্য দেওয়া যেতে পারে।
ষষ্টত, বাংলা, প্রাথমিক বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় আরো সীমিত আকারে প্রণয়ন করা হলে তা শিক্ষার্থীদের কাছে বোঝা মনে হবে না। এছাড়া শিক্ষা ভ্রমণ প্রতি বছর আয়োজন করা যেতে পারে।
সপ্তমত, কিছু শিক্ষার্থী আছে যারা যা-ই পড়ে তা মনে রাখতে পারে না। এদের দুর্বল ভাবার কারণ নেই। এদেরও প্রতিভা আছে। এদের পছন্দের বিষয়গুলো অন্বেষণ করে আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা করা হলে ভালো হবে।
অষ্টমত, কর্মরত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে তাদের প্রতিভাভিত্তিক। যে শিক্ষক যে বিষয়ে পারদর্শী তাঁকে সে বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তারপর সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে কলেজ পর্যায়ের বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা যেন মেধাবীরা এগিয়ে আসে।
নবমত, শিক্ষার্থী হিসাবে পুষ্টি চালু করা (ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা) এবং মেডিক্যাল সার্ভিস অন্তত মাঝে একদিন চালু করা। অসুস্থতার কারণে অনেকে বিদ্যালয় আসতে পারে না।
দশমত, অনেক আমলা আসেন আমাদের কর্মকর্তা হিসাবে। তাঁরা শিক্ষক হিসাবে পাঠদান করলে মূল সমস্যা অবলোকন করতেন, তাহলে তাদের জ্ঞানের আলোয় হয়তো আলোকিত হতো আমাদের সাজানো বাগান।
সর্বোপরি একজন প্রাথমিক শিক্ষকের মূল বেতন ৯,৭০০ টাকা থেকে শুরু। কিভাবে এতে মেধাবীরা এগিয়ে আসবেন, কিভাবে মানোন্নয়ন সম্ভব হবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করলে হবে না, শিক্ষকদেরও অধ্যয়ন করতে হবে। এ বেতনে টিউশনি দিয়ে যা সংসার চলে, তারপর আর অধ্যয়ন! শিক্ষার মান উন্নয়নে ‘আমি বড়ো তুমি ছোটো’—এ থেকে বের হতে না পারলে আমরা এগুতে পারব না।
লেখক : সালমা আহমেদ, মৌলভীবাজার।