ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক:  গত ১৭ বছরে ঘুষ দিয়ে যারা আসল সনদ  কিনেছিলেন বা ফলাফল টেম্পারিং করেছিলেন ‘ফরেনসিক অডিটের’ মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। পরীক্ষা না দিয়েও বোর্ড থেকে আসল সনদ বানিয়ে নেওয়ার অভিযোগ থেকে বোর্ডকে মুক্ত করতে শুরুতেই কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দেয়া ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারিদের সনদ ফরেনসিক অডিটের  আওতায় আসবে। এর ফলে গত ১৭ বছরে যতজন ডিপ্লোমা ডিগ্রি পেয়েছেন তাদের সনদ যাচাই হবে। এরপর এসএসসি (ভোকেশনাল) ডিগ্রিধারীদের সনদও ফরেনসিক অডিটের মাধ্যমে যাচাই করা হবে। সেই হিসেবে ভোকেশনাল থেকে গত সাত বছরে এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের সনদ যাচাই হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি বুয়েটের আইআইসিটি বিভাগ একটি সফট্ওয়্যারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করবে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, বুয়েটের সঙ্গে ডিবি ইতিমধ্যে কথা বলেছে। ফরেনসিক অডিটে সব ধরা পড়বে। এ জন্য বোর্ডের ওএসডি চেয়ারম্যানকে আবারো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। 

এদিকে ফরেনসি অডিটের বিষয়ে কারিগরি বোর্ডকে যাবতীয় নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা অধ্যাপক মামুন উল হক।  

প্রসঙ্গত, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচার, ফিসারিজ, লাইভস্টক, ফরেস্ট্রি, মেডিকেল টেকনোলজি বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেয়া হয়।

জানা যায়, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দেয়া ডিপ্লোমা সনদগুলো যাচাই হবে। পরে ২০১৭  থেকে এসএসসির (ভোকেশনাল) সনদও যাচাই। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার সিস্টেম এনালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামান টাকার বিনিময়ে সনদ দেয়ার দায়ে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দেই অভিযুক্ত হয়েছিলেন। সে সময়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এর সত্যতা পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। পাশাপাশি তাকে সিস্টেম এনালিস্টের পদ থেকে সরিয়ে পরিদর্শন শাখায় বদলি করা হয়। কিন্তু গতবছর থেকে সে আবার সিস্টেম এনালিস্ট পদে ফিরে আসে। 

সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী টাকার বিনিময়ে জাল সনদ দেয়ার অপকর্ম শুরু হয়। ২০১৭ সাল থেকে এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষার ফলাফলেও নাম্বার টেম্পারিং হতো। 

সম্প্রতি বোর্ডটির সিস্টেম এনালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামান পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সনদ বাণিজ্যের কথা বেরিয়ে আসে। এমন অপরাধে বোর্ডের চেয়ারম্যানের স্ত্রীসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বোর্ডের চেয়ারম্যানকেও অব্যাহতি দেয়া হয়।

ধারণা করা হয় কমপক্ষে দশ হাজার সনদ জালিয়াতি করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, পরীক্ষা দিয়ে পছন্দমতো স্কোর করতে না পারলে, কিংবা ফেল করলে ওই পরীক্ষার্থী কারিগরি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তৈরি হওয়া সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারিগরি বোর্ডের সিস্টেম এনালিস্টের কাছে পৌঁছে যেতেন। তারপর প্রয়োজনীয় ঘুষের টাকা জমা দিয়ে পছন্দমত সনদ নিতেন। তিনি বলেন, পরীক্ষা দিয়ে কেউ হয়ত সিজিপিএ-২ স্কোর পেলেন। টাকা দিলে সেটি সিজিপিএ-সাড়ে ৩ হয়ে যেত। পরিবর্তী সময় স্কোরের সনদ অনলাইনেও আপলোড করা হতো। এমনভাবে সনদটি দেয়া হতো সেটি মোটা দাগে ধরার কোনো সুযোগ থাকত না।

২০০৭ থেকে শুরু হলেও ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ পর থেকে এমন দুনম্বরি বোর্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারমতে, দেশজুড়ে একাধিক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও অধ্যক্ষরা এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। এদিকে, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের হাজার-হাজার সার্টিফিকেট জালিয়াতির ঘটনায় ওএসডি হওয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবরকে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ডিবি কার্যালয়ে তলব করে প্রায় ৩ ঘণ্টা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাকে গেফতার করা হতে পারে বলেও জানা গেছে। 

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের হাজার হাজার সার্টিফিকেট জালিয়াতির ঘটনায় ওএসডি হয়েছেন বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর তার স্ত্রী শেহেলা পারভীনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেছেন, সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত মনে হলে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া আলী আকবরকেও গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি বলেন, চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।

তিনি জানিয়েছেন, বোর্ডে পর্যাপ্ত পরিমাণ লোক ছিল না। তাই নজরদারি রাখতে পারেননি। তবে তিনি এই জালিয়াতির দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না উল্লেখ করে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমরা অনেক প্রশ্ন করেছি। তিনি দুয়েক দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা দেবেন। হারুন অর রশিদ আরো বলেন, আজকের মতো ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু চেয়ারম্যানকে আবারো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি এখনো আমাদের নজরদারিতে আছেন। বুয়েটের একটি প্রতিনিধি দলকে নিয়ে আবারও তার সঙ্গে বসব। আমাদের যদি মনে হয় তিনি জড়িত তবে তাকেও গ্রেপ্তার করা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ জালিয়াতির ঘটনায় একের পর এক বেরিয়ে আসছে অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার নাম। এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আছেন সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরাও। শিগগিরই এসব রাঘব-বোয়ালদের গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছে ডিবি। সনদ বাণিজ্যের ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আলোচিত নাম হলো কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খানের স্ত্রী সেহেলা পারভীন। ইতোমধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবরকেও।

সনদ বাণিজ্যের ঘটনায় রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় মামলা হয়েছে। এই মামলায় এখন পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামান, তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সাল, কুষ্টিয়া গড়াই সার্ভে ইনস্টিটিউটের পরিচালক সানজিদা আক্তার কলি, কামরাঙ্গীরচর হিলফুল ফুজুল টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও ঢাকা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালক মো. মাকসুদুর রহমান ওরফে মামুনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি লালবাগ বিভাগ।

এ বিষয়ে ডিবি লালবাগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, এই দুর্নীতির খনির ভেতরে আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি। এখানে আমাদের আরো কাজ বাকি রয়েছে। এ ঘটনায় যারা জড়িত আছেন তাদের তালিকা করা হচ্ছে। যারাই এর সঙ্গে জড়িত আছেন তাদের সবাইকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে। গ্রেপ্তার হওয়া ৬ জন ছাড়া সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আরো তিন কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিবিএ নেতা আব্দুল বাছের, রেজিস্ট্রেশন শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার মামুনুর রশীদ ও বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া আব্বাস। তারা বিভিন্ন সময় বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামানকে শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট পরিবর্তন ও জাল সার্টিফিকেট তৈরি করার কথা বলতেন। তাদের দাবি অনুযায়ী শামসুজ্জামান সনদ তৈরি করে দিতেন এবং রেজাল্ট পরিবর্তন করে দিতেন।

নরসিংদী, ময়মনসিংহ, খুলনা, দিনাজপুর, গাজীপুর, ঢাকা ও কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার দালালরা ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা তার কাছ থেকে সার্টিফিকেট বানিয়ে নিতেন।

রিপোর্ট প্রকাশের ভয় দেখিয়ে শামসুজ্জামানের কাছ থেকে ঘুষ নিতে বলে এক ভিডিওতে কয়েকজন সাংবাদিকের নাম এসেছে । তাদের মধ্যে নিজামুল হক, শরীফুল আলম সুমন, সাব্বির নেওয়াজ অন্যতম। এই তিনজনের বিরুদ্ধে স্ব স্ব পত্রিকা অফিস তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। শরীফুল আলম সুমনকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে  পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041170120239258