উপমহাদেশের সংগীত জগতের এক উজ্জল নক্ষত্র ফিরোজা বেগম। তিনি ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে ফরিদপুর জেলার কাশীয়ানী থানার ঘোনাপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম খান বাহাদুর মুহাম্মদ ইসমাইল এবং মাতার নাম কাও-কব-উনন্নেসা। পিতা ছিলেন একন বিশিষ্ট আইনজীবী। পশ্চিমবঙ্গের আলীপুর কোর্টে তার কর্মজীবন শুরু হয়েছিলো তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের আমলে প্রথম মুসলিম সরকারি আইনজীবী হিসেবে। তিনি বহুমুখী সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান যেমন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত করেন। তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি নিজেও সংগীত প্রেমিক ছিলেন।
শিল্পী ফিরোজা বেগম আট বছর বয়স থেকে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় সংগীত সাধনায় ব্রত হন। তিনি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে অডিশন দিয়ে শিশুশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে অনুষ্ঠানে গান করতে শুরু করেন। সেই থেকে সংগীত জগতে যাত্রা শুরু। কিশোরী ফিরোজা বেগম শুধু গান নয়, পাশাপাশি অভিনয়, নৃত্য, আবৃত্তি, সাঁতার প্রতিটি বিষয়ে প্রতিযোগিতায় প্রথম হতেন। তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজী নজরুলের অনেক নাটকে গানসহ অভিনয় করেছিলেন।
সংগীতশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে তার সংগীত শিক্ষক ছিলেন চিত্ত রায় এবং কমল দাশগুপ্ত। পরবর্তীতে কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কমল দাশগুপ্তের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারই কাছে সংগীত শিক্ষা লাভ করেন।
উল্লেখ্য, কমল দাসগুপ্ত কাজী নজরুলের একজন ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে বহু বছর এক সঙ্গে কাজ করেন। তিনি একজন প্রখ্যাত শিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন। ফিরোজা বেগম নজরুল সংগীত ছাড়াও আধুনিক গান, গীতগজল, কাওয়ালী, ভজন, হামদ্, নাত, লঘু ক্লাসিকাল, রবীন্দ্রসংগীতসহ বিভিন্ন ধরণের গানে পারদর্শী ছিলেন।
নজরুল সংগীতের লং প্লে (রেকর্ড) ও উর্দু গজলের বহু রেকর্ড তার কণ্ঠে প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে নজরুল সংগীতের রেকর্ড শুনে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক অসাধারণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে তার গীত ১২টি এলপি (লং প্লে) ১২টি ইপি, ৬টি সিডি, এবং ২০টির মতো অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়ে।
শিল্পী হিসেবে তিনি বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং বাংলা গানের প্রচার ও প্রসারে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি চীন, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একাধিকবার সংগীত পরিবেশেন করতে যান। জানা যায়, তিনি সর্বমোট ৩৮০টি একক অনুষ্ঠান করেন। কাজী নজরুলের গান পরিবেশন ও প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত সুখ্যাতির সঙ্গে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন।
ফিরোজা বেগম কণ্ঠশিল্পী ছাড়া স্বরলিপিকার হিসেবেও অবদান রেখেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম অসুস্থ হওয়ার পর তিনিই প্রথম নজরুল সংগীতের স্বরলিপি রচনা করেন যা ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের হরফ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে বাংলা একাডেমির অনুরোধ পেয়ে ১০০টি নজরুল সংগীত স্বরলিপির জন্য প্রদান করেন। বাংলা একাডেমি থেকে তিনটি স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও নজরুল একাডেমিকে ৫০টি গান ও ‘বইঘর’ কে ১০০টি স্বরলিপি প্রদান করেন, যদিও আজও তা প্রকাশিত হয়নি। খ্যাতনামা শিল্পী ফিরোজা বেগম দেশ-বিদেশ থেকে অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। সরকার কর্তৃক সংগীতে অবদানের জন্য তিনি ‘স্বাধীনতা পদক’ এবং ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি বহু বেসরকারি পদক ও সম্মাননা লাভ করেন।
সংগীতে অসামান্য কৃতিত্বের সঙ্গে-সঙ্গে তিনি বিভিন্ন সমাজকল্যাণ কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। বারডেম হাসপাতালের প্রতিষ্ঠালগ্নে এর প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর ইব্রাহিম-এর অনুরোধে আর্থিক সহায়তার জন্যে তিনি চ্যারিটি শো করেন। সম্মানস্বরূপ তার বারডেম হাসপাতালের আজীবন সদস্য করা হয়। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার সেন্টার ও ওয়েলফেয়ার হোম-এর সাহায্যার্থেও তিনি চ্যারিটি শো করেন।
কমল দাশগুপ্ত ও ফিরোজা বেগম দম্পতির ৩ পুত্র সন্তান রয়েছে। বাংলা সংগীতের এই গুণী শিল্পী ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।