ফুটপাতে মায়েদের ‘চাকরি’

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সোমা আখতারের ছেলে পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। বেলা ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত সন্তানের অপেক্ষায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে গণভবন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে ফুটপাতে তিনি বসে থাকেন। শুধু সোমা নন, এ ফুটপাতে অনেক মাকেই বসে থাকতে হয়। 

সোমা বললেন, ‘আমার বাসা শ্যামলী। স্কুলে সন্তানকে রেখে আবার বাড়ি যেতে হলে আসা-যাওয়ায় প্রায় ১২০ টাকা খরচ হয়। প্রতিদিন এই খরচের ধাক্কা সামলানো কঠিন। এখানে অপেক্ষারত মায়েদের কারও বাড়ি উত্তরা, কারও ধানমন্ডি। তাই এখানেই মাদুর পেতে, মোড়ায় বসে দুপুরের খাবার খাই। টিফিনের সময় বাচ্চাদেরও খাইয়ে দিই। তারপর স্কুল ছুটি হলে একেবারে বাড়ি ফিরি।’শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শুভা জিনিয়া চৌধুরী।

সোমা আখতারসহ অন্য মায়েরা জানালেন, দীর্ঘ সময় রোদ-বৃষ্টি বা যেকোনো পরিস্থিতিতে বসে থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে শৌচাগারের সমস্যা বড় সমস্যা। এই মায়েরা স্কুলের ভেতরে ঢুকতে পারেন না বা তাঁদের জন্য আলাদা কোনো কক্ষও নেই। তাই দীর্ঘ সময় শৌচাগারে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়। এতে দেখা দিচ্ছে নানান শারীরিক সমস্যা।

রাজধানীর ছোট–বড় প্রায় সব স্কুলের সামনেই মায়েদের অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তবে অনেকে বাঁকা চোখে তাকান এই মায়েদের দিকে। ভাবেন, ‘ভালোই মজা। কাজ তো নেই।’ সত্যিই কি তাঁদের কাজ নেই?

স্কুলের সামনে অপেক্ষারত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মা বললেন, ‘অনেক সময় সন্তানের বাবাও “ভালোই তো বান্ধবী জুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছ” এ ধরনের কথা শোনান। কিন্তু উপায় তো নেই। দিনের বেশির ভাগ কর্মঘণ্টাই নষ্ট হচ্ছে। বাসায় ফিরে আবার সংসারের কাজ আমাকেই করতে হচ্ছে। পরের দিনের কাজ গুছিয়ে তারপর বাসা থেকে বের হচ্ছি। কিন্তু এ কষ্টের মূল্যায়ন নেই, তাই মাঝেমধ্যেই খারাপ লাগে।’

ধানমন্ডি ৮ নম্বর সড়কে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ শাখার পাশে মায়েদের বসার জন্য নির্দিষ্ট একটি ছাউনি রয়েছে। সেখানে কথা হলো দুজন অভিভাবকের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মা বেশ ক্ষুব্ধ স্বরেই বললেন, ‘এখানে তো কেউ শখ করে বসে থাকে না। এলাকাভিত্তিক কোনো স্কুলের ব্যবস্থা নেই বা ভালো স্কুল নেই। যত দূরেই হোক, ভালো স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেলে পড়াতেই হবে। তখন খরচের বিষয়টি সামনে আসে। আবার স্বনামধন্য স্কুলগুলোরও নিজস্ব কোনো পরিবহনব্যবস্থা নেই। মেয়ের নিরাপত্তা তো সবার আগে।’

 একাধিক মা জানালেন, কিছু স্কুলে স্কুলভ্যানে যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলোতে যৌন হয়রানির খবর গণমাধ্যমেই পড়েন তাঁরা। তাই ভরসা পান না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিসি) তত্ত্বাবধানে কিছু স্কুল বাস চালু করা হলেও তারও এখন তেমন দেখা মেলে না।

এ যাত্রীছাউনিতে কমলাপুর থেকে আসা আসমা আখতারের (ছদ্মনাম) কোলে ৫ মাস বয়সী সন্তান। বসার জায়গা না পাওয়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। জানালেন, বড় মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার ক্লাস শুরু হয় সকাল সাড়ে সাতটায়। শেষ হয় ১১টায়। এই সাড়ে তিন ঘণ্টা তিনি ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করেন। যানজটের কারণে বাসায় ফিরে যেতে পারেন না। ছোট্ট মেয়েটিকে বাসায় দেখাশোনারও কেউ নেই। বড় মেয়ের টিফিনের পাশাপাশি ছোট্ট মেয়েটির খাবারও সঙ্গে নিয়ে আসেন। এই ছাউনিতে বসেই তাকে খাওয়ান। ঘুম পাড়ান।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের সামনে এই ছাউনিতে সন্তানের জন্য অপেক্ষা করেন মায়েরা। ছবি: প্রথম আলো
ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের সামনে এই ছাউনিতে সন্তানের জন্য অপেক্ষা করেন মায়েরা। ছবি: প্রথম আলো
ধানমন্ডিতে পারিজাত স্কুলে সাবিহা নাজনীনের মেয়ে নার্সারিতে পড়ে। মোহাম্মদপুর থেকে মেয়েকে নিয়ে সাতসকালে ধানমন্ডিতে আসেন তিনি। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ক্লাস শুরু হয়। ছুটির সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেন স্কুলচত্বরে রাখা বেঞ্চে বসে। সাবিহা বললেন, অপেক্ষারত মায়েদের বাচ্চার বাবারা চাকরি করেন। তাই চাইলেও সময় মিলিয়ে আসতে পারেন না। অনেক মা আছেন যাঁরা শুধু সন্তানকে স্কুলে আনা-নেওয়ার জন্যই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ‘স্যাক্রিফাইস’ তো মায়েদেরই করতে হয়।

শোভা ফারহানার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে বেসরকারি উইমেন্স ফেডারেশন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মেজ ছেলে পড়ে ল্যাবরেটরি স্কুলে। আর ছোট মেয়ে ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলে। সকাল সাতটা থেকেই তিনজনকে নিয়ে তিন দিকে ছোটাছুটি শুরু হয় তাঁর। যার যার স্কুল থেকে সবাইকে নিয়ে বাসায় ফেরেন মধ্যদুপুরে। শুক্র ও শনিবারও একই রুটিন। সন্তানের ড্রয়িং বা গানের ক্লাসে বসে থাকতে হয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছিলেন শোভা ফারহানা। সন্তানদের দায়িত্বের কথা ভেবে চাকরি করা হয়নি। বললেন, চাকরির চেয়ে এ দায়িত্ব তো আরও বড় মায়ের কাছে।

রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের সামনে অপেক্ষারত মায়েরা জানালেন, তাঁরা স্কুলের সামনে বসে শুধু আড্ডাই দেন না, সংসারের টুকিটাকি কেনাকাটাও করেন। এই মায়েদের কেন্দ্র করেই শাকসবজি, কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্যের পসরা নিয়ে বসেন বিক্রেতারা। কেউ কেউ এই সময়ে সন্তানের পড়া তৈরি করেন।
পারিজাত স্কুলের সামনে অপেক্ষারত ইয়াসমিন জাহান অবশ্য সময়টাকে অন্যভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। তিনি হাতের কাজের নানা জিনিসপত্র তৈরি করে বিক্রি করেন।

স্কুলে সন্তানের জন্য অপেক্ষারত মায়েদের ফ্রিল্যান্সিং, ডেটা এন্ট্রি, বুটিক বা কুটিরশিল্পের কাজে অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা মোসতাফা খানম। তিনি বললেন, এভাবে সন্তানের অপেক্ষায় থাকতে গিয়ে মায়েদের বড় কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। অনেক মা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু কিছু কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। কাজের এ ধরনের নেটওয়ার্কগুলো আরও বাড়ানো দরকার। অপেক্ষার সময়টুকুতে মায়েদের ল্যাপটপ দেওয়া যেতে পারে। তাঁরা ডেটা এন্ট্রি বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করতে পারেন। সরকারি সংস্থা অথবা বেসরকারি সংস্থাগুলো এ ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে পারে।

 অধ্যাপক সুলতানা মোসতাফা খানম বললেন, বাইরের দেশগুলোতে এলাকাভিত্তিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। দেশে সে ধরনের পদ্ধতি গড়ে উঠতে পারে। এ ছাড়া স্কুল ছুটির পর শিক্ষার্থীদের স্কুলেই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা রাখা যায় এবং সেখানে শিক্ষার্থীদের খাবার, খেলা ও ঘুমের ব্যবস্থা থাকতে পারে। সেটা অর্থের বিনিময়েও হতে পারে। তাহলে শিক্ষিত এবং বিভিন্ন কাজে দক্ষ মায়েরা খণ্ডকালীন কাজ করতে পারেন। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি ১২শ’ শিক্ষার্থীর আতঙ্কে দিন কাটছে - dainik shiksha কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি ১২শ’ শিক্ষার্থীর আতঙ্কে দিন কাটছে বিলেত সফরে শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha বিলেত সফরে শিক্ষামন্ত্রী ডলার সংকটে কঠিন হচ্ছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা - dainik shiksha ডলার সংকটে কঠিন হচ্ছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা সুপাড়ি চুরির সন্দেহে দুই ছাত্রকে নির্যা*তন - dainik shiksha সুপাড়ি চুরির সন্দেহে দুই ছাত্রকে নির্যা*তন ডক্টরেট ডিগ্রি পেলো বিড়াল - dainik shiksha ডক্টরেট ডিগ্রি পেলো বিড়াল নামী স্কুলগুলোর ফলে পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে - dainik shiksha নামী স্কুলগুলোর ফলে পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034968852996826