ইতিহাসের পর্দা উন্মোচিত হচ্ছে। সদ্য প্রকাশিত মার্কিন গোপন দলিল এই চাঞ্চল্যকর সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতেই শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট বার্তা পায় যে, তার দাবি পূরণ না হলে তিনি একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং সেই ক্ষেত্রে গৃহযুদ্ধ এড়াতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অন্যদিকে আরেক চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার সহকারী কিসিঞ্জার দু'জনেই ফেব্রুয়ারিতে একমত হয়ে মুজিবকে জানিয়ে দেন যে, একান্তই যদি তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১
পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ড. হেনরি কিসিঞ্জার দুই পৃষ্ঠায় টাইপকৃত এক স্মারক পেশ করেন প্রেসিডেন্টের কাছে। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই চিঠির অবিকল তর্জমা নিম্নরূপ: ‘এমন সম্ভাবনা দৃশ্যত বেড়েই চলেছে যে, আমরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ। সংকটের মুখোমুখি হতে পারি, যা কি না দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের স্বার্থের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব বয়ে আনতে পারে। আমি কিছু আকস্মিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য নির্দেশ দিয়েছি এবং বর্তমান পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তার একটা বিবরণ দিচ্ছি। পাকিস্তানের জন্য একটি নতুন সংবিধান লেখার কাজ শুরু করা নিয়ে কঠিন সমঝোতা থেকে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আপনি জানেন মুখ্য ইস্যু হচ্ছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্ক। পূর্ব পাকিস্তানের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ এবং পশ্চিম পাকিস্তান এ পর্যন্ত নতুন সংবিধান নিয়ে এমনকি প্রাথমিক সমঝোতায় পৌছাতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেসামরিক রাজনীতিকদের ওপর তার সামরিক সরকারকে বজায় রাখতেই সংকল্পবদ্ধ। কিন্তু তিনি বলেছেন যে, তিনি পাকিস্তান বিভক্তির প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করবেন না।
গণপরিষদের অধিবেশন ৩ মার্চ আহবান করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টের অনুমোদনসাপেক্ষে সংবিধানের খসড়া তৈরি করতে ১২০ দিন সময়ের দরকার হবে। এই অনিশ্চয়তা ক্রমেই দানা বাঁধছে যে, উল্লেখযোগ্য পক্ষগুলোর নেতা- রহমান (মুজিব), ভুট্টো ইয়াহিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদ সক্ষম হবে কি না? রহমান এখন পরিকল্পনা করছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে অটল থাকতে এবং যদি তিনি তা না অর্জন করতে পারেন, সেক্ষেত্রে প্রবল সম্ভাবনা হচ্ছে- পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা।
তার পক্ষ থেকে এটা হতে পারে সমঝোতার জন্য কোনো কৌশল; কিন্তু এটাও ঠিক যে, শক্তিশালী এবং ক্রমবর্ধমান প্রাদেশিক জাতীয়তাবাদ রহমানের নমনীয় হওয়ার সুযোগকে সীমিত রাখবে এবং সর্বোচ্চ দাবি আদায়ে তার সে উল্লেখযোগ্য সাংগঠনিক দক্ষতা রয়েছে। মুজিবের মনোভাব যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য কূটনীতিকদের কাছে তার সাম্প্রতিক আবেদন দ্বারাও মূল্যায়ন করা চলে। তিনি জানিয়েছেন যে, যদি তিনি তার পথ খুঁজে না পান এবং একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তাহলে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে একটি গৃহযুদ্ধ এড়াতে আমরা যেন শান্তি রক্ষায় ভূমিকা পালন করি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সত্যিই বড় অনিশ্চিত, যা আমাদেরকে খুব সংকীর্ণ রশির ওপর দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করছে। যে কোনো অর্থেই আমরা নিয়ন্ত্রণকারী 'ফ্যাক্টর নই।
কিন্তু উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আমাদের প্রভাব ও সমর্থন চেয়েছেন। আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ নিশ্চয়ই রয়েছে এবং এই সন্ধিক্ষণে আমাদের মনোভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেখতে হবে যে, ভবিষ্যতে আমাদের স্বার্থ কিভাবে রক্ষিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হচ্ছে আমরা পাকিস্তানের ঐক্য সমর্থন করি। কিন্তু এটা অকারণে নয়। কতিপয় পাকিস্তানি রাজনীতিক অভিযোগ করেছেন, যা তাদের নিজ উদ্দেশ্যে- যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতায় মদদ দিচ্ছে এবং আমরা এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে আমাদের অবস্থানে স্থির রয়েছি।
সে কারণে ঢাকায় আমাদের কনসাল জেনারেল রহমানের কাছে এই আরজি রাখেন যে, তিনি যেন একটি সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং রহমান যদি পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে যেতেও মনস্থির করেন, যুক্তরাষ্ট্র সেক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে (প্রেসিডেন্ট নিক্সন মুজিবের সঙ্গে কনসাল জেনারেলের যোগাযোগের এই বাক্যটি কলম দিয়ে দাগ কাটেন এবং মন্তব্য জুড়ে দেন: ভালো [গুড]।) তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রত্যক্ষ করতে হবে। যদিও বর্তমানের বিচ্ছিন্নতার হুমকি সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা সমঝোতা চান। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা ঐ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি।
আর সে কারণে এটা চিন্তা করার সময় এসেছে যে, আমরা রহমানের প্রতি একটি অধিকতর নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করব কী করব না। রহমান প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন (নিক্সন এই অংশটির নিচে কলম দিয়ে দাগ কাটেন এবং নোটের নিচে লেখেন: এখনো নয়- সঠিক, কিন্তু বিচ্ছিন্নতাকে উৎসাহিত করে এমন কোনো অবস্থান গ্রহণ নয়)। তাছাড়া ভবিষ্যতের স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার জন্য এটা রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে। একটি বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন নির্ধারণ করতে হলে এটা স্বীকার করতে হবে যে, অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে আর অতি সামান্য সম্ভাবনাই হয়তো অবশিষ্ট থাকতে পারে। এই বিবেচনায় আমাদের অবস্থানকে সমন্বয় করে নিতে হবে। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, পাকিস্তানের বিভক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূল হবে না।
অন্ততপক্ষে এটা দৃশ্যত নিশ্চিত করে বলা যাবে যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভক্তির সম্ভাবনা যেখানে ক্রমবর্ধমান সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কিভাবে উৎকৃষ্ট উপায়ে রক্ষা পেতে পারে সেজন্য আমাদেরকে একত্রে আকস্মিক অবস্থা মোকাবেলায় উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সে কারণে দক্ষিণ এশীয় নীতির ব্যাপকভিত্তিক সমীক্ষার বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন। আমি একটি বিশেষ কন্টিনজেন্সি প্ল্যান প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিয়েছি, যাতে প্রয়োজনের সময় আমরা ঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারি।" এ পর্যন্ত খতিয়ে দেখা বিভিন্ন মার্কিন দলিল এই ধারণা দিচ্ছে যে, নিক্সন ও কিসিঞ্জার বাংলাদেশ, ভারত ও রাশিয়া সম্পর্কে সময় সময় নানাভাবে বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত তাতে নেই। এমনকি বহুল আলোচিত সপ্তম নৌবহরের বিষয়টি সামরিক কৌশলগত ছিল। কিন্তু তা বাংলাদেশের অভ্যুদয় প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল বলে ধারণা করা যায় না। এর
সপক্ষে আরেকটি দলিল নিম্নরূপ:
ডিসেম্বর ১৯৭১
নতুন দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং এই টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও হোয়াইট হাউসে। এতে বলা হয়, 'গত কয়েকদিন ধরে আমি আমার এখানকার কূটনৈতিক সহকর্মীদের কাছ থেকে এই ধারণাই পাচ্ছি যে, বঙ্গোপসাগরে কেরিয়ার টাস্কফোর্সের মোতায়েন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সামরিক শক্তি প্রদর্শনের শামিল। এখানকার কানাডীয় হাইকমিশনার জর্জ আমাকে বলেছেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন এই মুহূর্তে নৌবহরের এই মোতায়েন পাকিস্তানি সামরিক প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে উৎসাহিত করবে। এ প্রসঙ্গে জর্জ মনে করেন, ফরমান আলী ও গভর্নর মালিকের সর্বশেষ বার্তার ভাষায় তেমন ইঙ্গিতই মিলছে।
তার কথায় এই মোতায়েনের ফলে প্রকৃতপক্ষে পরাশক্তির প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হয়েছে, আর এর ফলে সোভিয়েত শুধু নয়, চীনারাও একই সঙ্গে বিচলিত হতে বাধ্য। এটা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির পর্দা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। জর্জ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনিও এসব সম্ভাবনা উল্লেখ করে তার প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার্তা লেরণ করতে যাচ্ছেন, যাতে তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে পারেন।' কেনেথ কিটিংয়ের এই বার্তা থেকে স্পষ্ট ধারণা করা চলে যে, সপ্তম নৌবহর প্রেরণকে তিনি সুনজরে দেখেননি। অবশ্য নিক্সন ও কিসিঞ্জার যাদেরকে ভারতপন্থি মনে করতেন কিটিং ছিলো তাদের অন্যতম।