ফেসবুকে লাইক পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছি আমরা?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

'ইমোশনাল লিটারেসি' বা 'আবেগের সাক্ষরতা' এবং আত্ম-প্রেম নিয়ে কার্টুন আঁকেন লেহ পার্লমেন। সেগুলো ফেসবুকে প্রকাশ করার পর তার বন্ধুরা দারুণ সাড়া দেন।কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যেই ফেসবুকের এলগোরিদম বা গাণিতিক ভাষায় পরিবর্তন আনা হয়। এরপর থেকেই, পার্লমেনের কার্টুনগুলো আগের চেয়ে অনেক কম মানুষ দেখতে পেতো এবং খুবই কম 'লাইক' হতো।

বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট মনঃকষ্ট পেয়ে মিজ পার্লমেন বলেন যে, "মনে হচ্ছিল যেন আমি যথেষ্ট অক্সিজেন পাচ্ছিলাম না।"

পার্লমেনের ব্যাপারটা অনুমান করা যায়। কারণ লাইক বা সোশাল এপ্রুভাল বা সামাজিক অনুমোদন আসলে এক ধরনের নেশার মতোন। গবেষকরা স্মার্টফোনকে স্লট মেশিন বা কেসিনোতে জুয়ার মেশিনের সাথে তুলনা করেছেন। জুয়ার মেশিনের মতোই স্মার্টফোন-ও মানুষের মস্তিষ্কে একই রকম অনুভূতির জন্ম দেয়। বৃহস্পতিবার (২০ জুন) বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।

অধ্যাপক নাতাশা ডো শুল মনে করেন, জুয়ার মেশিনের নকশাটাই এমন যে, এটা আসক্তি তৈরি করে। তিনি মনে করেন, স্মার্টফোনগুলোও এমনভাবে তৈরি যাতে স্ক্রিনের সামনে মানুষ বেশিক্ষণ থাকে। এভাবেই আসক্তি তৈরি হয়।

লেহ পার্লমেন জানান, বেশি করে লাইক পাবার আশায় তিনি পরে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয়া শুরু করেন।

কমিক আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করার আগে পার্লমেন নিজেই একসময় ফেসবুক ডেভেলপার ছিলেন এবং তার টিমই ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে 'লাইক বাটন' আবিষ্কার করেন। কিন্তু অদ্ভুত রকমভাবে নিজের তৈরি লাইক-বাটনে নিজেই আসক্ত হয়ে পড়েন মিজ পার্লমেন। ব্যাপারটা যেন পরিহাসই বটে!

ফেসবুকের এই লাইক অপশন এখন ইউটিউব ও টুইটারেও রয়েছে। কমেন্ট লেখার চেয়ে একটি মাত্র ক্লিক করে নিজের প্রতিক্রিয়া জানানো অনেক সহজ। কিন্তু 'লাইক' এর ধারণাটা একদিনে বিকশিত হয়নি।

মিজ পার্লমেন বলছিলেন, 'লাইক' নিয়ে খোদ জাকারবার্গকে তার বহু বোঝাতে হয়েছে। 'লাইক' বাটনটাকে 'অসাম' বা 'দুর্দান্ত' বাটন বলা হবে কিনা, এটি আদৌ মানুষ গ্রহণ করবে কিনা - এই বিষয়গুলো সামনে এসেছিল তখন। তবে অনেক শ্রমের পর অবশেষে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে 'লাইক' বাটন চালু হয়। চালুর পরপরই এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

সাইকোমেট্রিক্স বা মানুষের মনোজগতের কর্মপদ্ধতি নিয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময় পিএইচডি করছিলেন মাইকেল কোসিনস্কি। তার মতোই তখন আরেক শিক্ষার্থী আলেকজান্ডার কোগান। ফেসবুক অ্যাপ দিয়ে মানুষের অন্যতম ৫টি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরীক্ষার বিষয়টি তখন সামনে এনেছিলেন মি. কোগান।

পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ছিল - অকপটতা, সুবুদ্ধি, বহির্মুখিতা, অমায়িকতা ও বাতিকগ্রস্থতা। ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে নিজেই ফেসবুকে করা এই টেস্ট বা পরীক্ষাটা তখন ভাইরাল হয়েছিল। এই টেস্ট বা পরীক্ষাগুলো ফেসবুকে যে সব ব্যবহারকারী করতেন তাদের ফেসবুক প্রোফাইল, বয়স ও লিঙ্গসহ আরও বেশ কিছু ব্যক্তিগত তথ্য তখন গবেষকদের হাতে চলে যেতো। লাখ-লাখ ডাটা তখন গবেষকদের হাতে আসে। এ সময় তারা ফেসবুক ব্যবহারকারী যত কিছুতে লাইক দিয়েছেন সেগুলোসহ তাদের ফেসবুক-বন্ধুদের সকল পাবলিক ডাটা দেখার অধিকার পান।

মাইকেল কোসিনস্কি এখন বর্তমানে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। তিনি মনে করছেন, ফেসবুক টেস্ট থেকে পাওয়া সেই ডাটাগুলো ছিল এক অমূল্য রত্ন-ভাণ্ডার। কে কোন বিষয়ে লাইক দিচ্ছেন সেটি দেখেই মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, তার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস ও ভাবনা থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুই নিখুঁতভাবে বলে দেয়া যায় বলে মনে করেন ড. কোসিনস্কি।

এরপর থেকেই ফেসবুক ডাটা নিয়ে কিছুটা রক্ষণশীল হয়। অ্যাপ ডেভেলপাররা এখন আর আগের মতোন যে কোনো ডাটা পান না। কিন্তু ফেসবুক নিজে ঠিকই ব্যবহারকারীর সব ডাটা দেখতে পায়। এতো বিপুল ডাটা জানা থাকায় ফেসবুক এখন নিউজফিডকে ব্যবহারকারীর পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর সুযোগ পাচ্ছে। যে ব্যক্তি যেই ধরনের কন্টেন্ট যেমন নিউজ বা গান বা অনুপ্রেরণামূলক ভিডিও দেখতে পছন্দ করেন তার নিউজফিডে সেগুলোই বেশি করে আসছে।

এমনকি রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও এরকম পছন্দ-অপছন্দের বিষয় মেনেই ফেসবুক ব্যবহারকারীর নিউজফিড তৈরি করা হয়। ফলে, এখন ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে বিজ্ঞাপন দেয়াটা সহজতর হয়ে উঠেছে।

প্রচুর ডাটা থাকার মানুষের পছন্দ-অপছন্দের বিষয় জেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের জয়কে ত্বরান্বিত করেছিলেন। অর্থাৎ মানুষের আবেগের জায়গাটিকে ফেসবুক হয়তো চাইলে প্রভাবিত করার প্রচুর সুযোগ রয়েছে।

তবে, ফেসবুকের চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল সেন্ডবার্গ ২০১৮ এর ডিসেম্বরে বিপুল সংখ্যক মানুষের ডাটা বেহাত হবার প্রসঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ডাটা নিয়ে তাদের যতটা সতর্ক হওয়া দরকার ছিল ২০১৬ খ্যিষ্টাব্দের আগে ততটা তারা ছিল না। তাছাড়া এই প্ল্যাটফর্মটিকেও যে অপব্যবহার করা যেতে পারে সেটিও তারা পূর্বানুমান করতে পারেননি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

তবে কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, ফেসবুকের কাছে মানুষের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে প্রচুর তথ্য থাকলেও এটি এখনো মানুষের মনের নিয়ন্ত্রণ নয়। কিন্তু বিপুল পরিমাণ কন্টেট দিয়ে ফেসবুক যে মানুষকে দীর্ঘসময় আটকে রাখছে, সেসব থেকে নিজেদের কীভাবে দূরে রাখবো?

এক্ষেত্রে অনেক গবেষক বলছেন, ফেসবুক অলগারিদম কীভাবে আমাদের ওপর প্রভাব রাখছে তা নিয়ে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের 'ইমোশনাল লিটারেসি' থাকতে পারে। তবে ফেসবুকে 'সামাজিক অনুমোদন' যদি অক্সিজেনের মতো জরুরি মনে হয়, তাহলে 'আত্ম-প্রেম' বা নিজেকে ভালোবাসাই এর যথার্থ সমাধান হতে পারে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041120052337646