সাইবেরিয়া থেকে ফি শীতে পরিযায়ী পাখিরা আসে; আমি অনেককে জানি যারা বার্লিন, সিডনি, নিউইয়র্ক কিংবা বিলেত থেকে ঠিক এই সময়ে পরিযায়ী পাখির মতো বাংলাদেশে ছুটে আসেন কেবল বইমেলার টানে! কী অদ্ভুত সুন্দর এই প্রাণের টান, ভাবলেই কান্না পায়, ভূ-ভাগে আবেগঘন এমন দ্বিতীয় জাতি মেলা ভার।
কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার-পাউন্ড-ইউরো খরচ করে হাজার মাইল দূর থেকে প্রতি বছর প্রবাসী বাঙালিরা ছুটে আসেন বইমেলার ভিড়ে নিজেকে শামিল করতে, এই আতম্ভর আশায় যে, তারা যেন এই মিলনমেলা থেকে বাদ না যায়; দূরে থাকলেও তিনি-ও যে এই সংস্কৃতির একজন গর্বিত উত্তরাধিকার মেলায় এসে তার জানান দিতে চান।
এভাবেই বইমেলা দেশি-প্রবাসী লাখো পাঠকের মনোজগতে শুভ অভিঘাতের সৃষ্টি করে চলেছে। তাই মেলায় থাকতে হবে নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ পাঠযোগ্য বৈচিত্র্যময় বই। উৎসাহ দিতে হবে নতুন লেখকদের। ভালো পাঠকই আখেরে ভালো লেখক তৈরি করে। বইমেলাকে তাই পাঠকবান্ধব না হয়ে উপায় নেই। বইমেলা কেবল বই কেনার নয়, বই দেখার বই শোঁকার বই ছোঁয়ার মেলা। পাঠক যেন নিশ্চিন্তে মেলার পবিত্র আঙিনায় ঘুরে বেড়াতে পারেন। প্রকাশক যেন পছন্দসই স্পেস পান। মুক্ত চিন্তার মেলা যেন সব অর্থেই মুক্ত হয়।
সবার মতামত নিয়ে মেলার পরিসরকে আরও সৃষ্টিশীল আরও আকর্ষণীয় করে নির্মাণের প্রয়াস নিতে হবে। প্রতিবছর মেলার আদল যেন একরকম না হয়; একঘেয়ে বিন্যাস থেকে বইমেলাকে তাই বেরিয়ে আসতে হবে। অন্দরমহল আর বহিরাঙ্গে প্রতিবছরই নতুনত্ব আর বৈচিত্র্য আনার উদ্যোগ নিতে হবে, নান্দনিক বিবেচনাকে ওপরে ঠাঁই দিতে হবে। ফরাসি চিন্তক জ্যাক দেরিদা একবার এই মন্তব্য করেছিলেন: ‘বই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে; প্রতীচী থেকে প্রাচীতে; বই এখন ফেরারি; ইউরোপ থেকে লেজ গুটিয়ে বই এখন ঘাড় গোঁজার চেষ্টা করছে ভারতবর্ষে’- পশ্চিমে অনলাইন-বই কিংবা শ্রুতিবই প্রকাশের হিড়িক দেখে ফি বছর একুশের বইমেলায় গা-ঘেঁষে-ঘন-হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বইয়ের স্টল আর উপচে পড়া জনসমাগম দেখলে মনে হয় দেরিদা ঠিকই বলেছেন; কিন্তু মুখোশ চিড়ে মুখ চেনাটাও জরুরি- জনারণ্যের কতজন বইয়ের ক্রেতা?
ভিড়-ঠেলা ক্রেতাদের কতজন পাঠক? আর গাদাগাদা পাঠকের কতজন আছেন যারা বইয়ের বাছবিচার করতে পারেন? ঠাকুর অনুকূল বলেছেন, তুষ ফেলে চাল নিতে। কতজন পারি, তুষ ঝেড়ে চাল বাছতে? অ-বই থেকে বই খুঁজে বই বের করতে? মেলার ঘাস যাদের পায়ের ঘষায় সবচেয়ে বেশি উঠে আসে তারা ওই নতুন প্রজন্মের দলভুক্ত। ঠিক যে বই মেলায় সবচেয়ে বেশি আসে তরুণরা, কিন্তু সংশয় আমার একশ ভাগ, তাদের মধ্যে কতজন আমরা সত্যিকার অর্থে বইয়ের অ্যাপ্রিশিয়েশন করতে পারি। বইমেলা বছরের পর বছর ধরে ‘প্রকৃত পাঠক’ না একদল ‘হুজুগে পাঠক’ তৈরি করছে তার হিসাব কষা জরুরি।
খেয়ালে আনলে বোঝা যাবে হুজুগে পাঠক কোনো বাছবিচার করে না, ভিড় দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বই কেনে, বাসায় ফিরে উত্তেজক মলাট উল্টায়, বিছানায় শুয়ে গোগ্রাসে বই গেলে, মচমচ করে পাতা খায়। ভুলে গেলে ভুল হবে যে, ভিড় কিন্তু ভিড়ের রুচিই তৈরি করে। স্বতন্ত্র রুচি তৈরির সুযোগ সেখানে কোথায়? আবার এটাও তো কোনো সুস্থ লক্ষণ নয় যে, বই প্রকাশনা নির্ভর হয়ে পড়েছে একান্তই একুশের বইমেলার ওপর; কেননা আমাদের উচিত কেবল মেলা নয়, সারা বছরই এমন উদ্যোগ নেওয়া যাতে নতুন প্রজন্ম বই পাঠে সত্যিকারের যে আনন্দ সেই স্বাদ নিতে সক্ষম হয়ে ওঠে, যাতে বই অ্যাপ্রিশিয়েশনে দুর্বলতা কাটিয়ে সাবালকত্ব অর্জন করতে পারে।
রুচি মানেই নির্বাচন। নির্বাচন কেবল পাঠকের বই কেনায় নয়, সবচেয়ে জরুরি বই প্রকাশের নির্বাচন। বাছবিচার এখানে অনপনেয়। নইলে নিম্নমানের বাজারিতে বইমেলা ছেয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। নতুন প্রজন্মের একজন হিসেবে আমার চাওয়া তাই স্পষ্ট- বইমেলা কেবল মুনাফামুখিনতায় যেন পর্যবসিত না হয়। তথাকথিত বিশ্বায়নের দোহাই পেড়ে বই প্রকাশ আর বইমেলা স্রেফ বাজারিপনায় যেন আটকে না যায়। বই পণ্য মানি, সাবান পণ্য এও মানি, কিন্তু গোল বাধে যদি এ দুয়ে পার্থক্য করতে না পারি। সাবানক্রেতা কেবল সাবানই কেনে, বইয়ের ক্রেতা বইয়ের সঙ্গে মতাদর্শ, ভাষা আর রুচিও ক্রয় করেন। সনাতনী ভাবনাকে বদলে দিয়ে নতুন ছাঁচে বই প্রকাশ ও তার বারতা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায় কিন্তু আমরা তাই এড়াতে পারি না। বইমেলার মাধ্যমে জাতির সভ্যতা, সৃজনশীলতা, বুদ্ধিবৃত্তি ও রুচির পরিচয় তুলে ধরার যে সুযোগ ফি বছর আসে আমাদের উচিত হবে তার যথার্থ ব্যবহার করা।
বইমেলা নতুন প্রজন্মের বইপ্রেমীদের তীর্থক্ষেত্র; এদের অনেকে বছরের বাকি এগারো মাস চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে একুশের এই মেলাটির জন্য! দেশে-বিদেশে কত মেলা হয়, না মন ভরে না; কত পানি কিন্তু চাতকের চাই মেঘের জল, কত মেলা কিন্তু এদের চাই একুশের মেলা। তরুণরা বয়সধর্মের কারণেই প্রতিবাদী হয়, প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করে, বিকল্পের সন্ধান করে। বৃত্তের বাইরে গিয়ে নিজের পারঙ্গমতার স্বাক্ষর রাখতে সাহস দেখায়। নতুন প্রজন্ম সব সমাজেই জীবন ঘনিষ্ঠতা, সৃষ্টিশীলতা আর দ্রোহের স্ফুরণ ঘটায়। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক রুচি যেন থাকে বই প্রকাশে- প্রজন্মের প্রত্যাশাও থাকে তাই। গ্রন্থমেলার কাছে তরুণদের আকাঙ্ক্ষা এটি তাদের রুচি নির্মাণে ভূমিকা রাখরে, তুষ-চালের বাছবিচারে সক্ষম করে তুলবে, নতুন ও উন্নত চিন্তার সঙ্গে মেলায় আসা পাঠকদের মেলবন্ধন ঘটাবে।
বইমেলাকে ঘিরে বাংলা একাডেমি, বইয়ের প্রকাশক, পাঠক আর লেখক- এই চার অংশের শুভ ও সৃষ্টিশীল সমন্বয় দেখার অপেক্ষায় থাকি আমরা। নতুন প্রজন্ম চায়, ভাষা আন্দোলনের যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা তার স্বভাবটি যেন মেলার আয়োজন আর বিন্যাসে প্রকাশ পায়। ভাষা আন্দোলন কেবল সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না, ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনও বটে- বইমেলায় এই দ্রোহ আর রাজনৈতিক স্পিরিট অটুট থাকুক যেন- এটাই প্রজন্মের ভাবনা। মেলার অনুবাদ যেন নিছক গাদাগাদি ঠাসাঠাসি আর ভিড়ভাট্টা না হয়ে ওঠে, কর্তৃপক্ষ তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবে, সৃষ্টিশীল তরুণ প্রজন্ম আন্তরিকভাবেই এটা চায়। গ্রন্থমেলা তরুণদের কাছে এত বিশেষ যে তারা কেবল বইপ্রেমের আবেগ আর তার উৎসারণ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে নারাজ, তারা চায় এটা সত্যিকার অর্থেই হয়ে উঠুক জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।
একুশ ছিল সত্যের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তরুণদের মনোজগৎও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। বাংলা একাডেমি একটি আন্দোলনের ফল। আশা থাকবে বইমেলায় সবসময় যেন সেই ভাবটা জাগরূক থাকে। একসময় বাংলা একাডেমিকে ‘ইসলামী বাংলা একাডেমি’ বানানোর যে চেষ্টা ছিল তরুণরা মোটেই তা ভালোভাবে নেয়নি। কারণ তারুণ্যের চেতনার সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক। তরুণরা ইতিহাসের বাঁকবদল করে ঠিকই কিন্তু তার লক্ষ্য পেছনে ফেরা না, প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ায় আত্মসমর্পণ করা না, তারা প্রাগ্রসর চিন্তাকে আলিঙ্গন করে ক্রমাগত আরও আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক সমাজ তৈরির পাটাতন নির্মাণের চেষ্টা চালায়।
নতুন প্রজন্ম কখনো সখনো বিপথগামী হতে পারে- মাদক, নারী উত্ত্যক্তকরণ, ধর্মান্ধতা কিংবা অন্ধকার জঙ্গিবাদের চর্চায় লিপ্ত হতে পারে, কিন্তু আমি অন্তকরণে বিশ্বাস করি এটা সাময়িক। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান পেলে তারা তাতে সাড়া দেবে ঠিকই- কিন্তু সে আহ্বান হতে হবে আন্তরিক, যুক্তিগ্রাহ্য আর গাঢ়। সূর্যের মতো স্পষ্ট আর সত্য কোনো ডাক দিয়ে গেলে তা এড়ানোর সাধ্য তাদের নেই। এ জন্য আলো ছড়াতে হবে, সত্যের বীজ রোপণ করে যেতে হবে। অন্ধকার থেকে আলোর সড়কে নিয়ে আসতে একটি জীবনবাদী বই মানুষকে যেভাবে আবাহন করতে পারে তার চেয়ে বেড় শক্তি আর কার আছে? নতুন প্রজন্মকে গ্রন্থমনস্ক করে গড়ে তোলার কোনো তাই বিকল্প নেই; গ্রন্থমনস্ক করা মানে প্রকারান্তরে মানুষকে জীবনমনস্ক করা।
লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন