উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তার অসীম অবদানের জন্যে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। তাকে সাধারণত প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে গীতার ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে, সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও তিনি বিশেষ খ্যাতিমান। তিনি জীবিকাসূত্রে ব্রিটিশ রাজের কর্মকর্তা ছিলেন। ছদ্মনাম হিসেবে কমলাকান্ত নামটি বেছে নিয়েছিলেন। তাকে বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয়, এছাড়াও তিনি বাংলা সাহিত্যের সাহিত্য সম্রাট হিসেবে পরিচিত।
বঙ্কিমচন্দ্র রচিত আনন্দমঠ উপন্যাসের কবিতা বন্দে মাতরম ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার আদিনিবাস ছিলো হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বপুরুষ রামজীবন চট্টোপাধ্যায় কাঁঠালপাড়ার রঘুদেব ঘোষালের কন্যাকে বিয়ে করেন৷ রামজীবনের পুত্র তথা বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহের সম্পত্তি পেয়ে কাঁঠালপাড়ায় আসেন এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। রামহরির পৌত্র যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বঙ্কিমচন্দ্র, মাতা দুর্গাসুন্দরী দেবী। বঙ্কিমের পূর্বে তার আরো দুই পুত্রের জন্ম হয় –শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থলে মেদিনীপুরে আসেন, সেখানেই তার প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তার স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানেও বঙ্কিম অল্পকালের মধ্যেই নিজ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। পূর্ণচন্দ্রের রচনা থেকে জানা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে টিড সাহেব বঙ্কিমকে ডবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হলে যাদবচন্দ্রের হস্তক্ষেপে তিনি নিরস্ত হন। ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে টিড ঢাকায় বদলি হয়ে গেলে সিনক্লেয়ার তার স্থলাভিষিক্ত হন; তার কাছেও বঙ্কিম প্রায় দেড় বছর ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন।
১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন। এইসময় কাঁঠালপাড়ার শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন। সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা তিনি এই বয়সেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বিরচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্য থেকে বিদ্যার রূপবর্ণন ও জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দম্ কাব্য থেকে ধীরে সমীরে যমুনাতীরে কবিতাদুটি তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন।
বঙ্কিম ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি কলেজে (অধুনা হুগলী মহসিন কলেজ) ভর্তি হন। এখানে তিনি সাত বছর পড়াশোনা করেন। হুগলি কলেজ পড়াকালীন ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরেই সংবাদ প্রভাকরে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার লাভ করেন। হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তার বহু রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি কলেজে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরই তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারি মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবারের মতো বিএ পরীক্ষা নেয়া হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু।
তার বাবার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যান। স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে - ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে কম্প্যানিয়ন অব দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অব দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে তিনি পরলোকগমন করেন।