বঙ্গবন্ধুর মুক্তি নিশ্চিতে যে অবদান রেখেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পরেও পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য নিয়ে শঙ্কা সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে বিরাট এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যবর্তন দিবস। তার দেশে ফেরা সহজ প্রক্রিয়ায় ছিল না। সম্প্রতি একজন ভারতীয় সাবেক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বঙ্গবন্ধুর মুক্তি নিশ্চিত করার নেপথ্যের একটি ঘটনা প্রকাশ্যে এনেছেন। খবর বাসসর।

সাবেক কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী সম্প্রতি প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লিখেছেন, সেই মুহূর্তে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে মূল উদ্বেগের বিষয় ছিল কিভাবে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবিত ও সুস্থ অবস্থায় তার দেশে ফিরিয়ে আনা যায়।

জেনারেল ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে পাকিস্তানের একটি সামরিক আদালত তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মৃত্যুদ- দিয়েছিল। ব্যানার্জীর ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশকে যাতে ‘এতিম রাষ্ট্র’ হতে না হয় সেজন্য ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচানোর জন্য যে কোন মূল্য দিতে প্রস্তুত ছিলেন।

ব্যানার্জী লিখেছেন, ভারত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করেছিল এবং নয়াদিল্লির জন্য ‘তার মৃত্যুদ- হতো এক শোচনীয় বিপর্যয়, এক স্বপ্নভঙ্গ।’

তিনি বলেন, ‘সুতরাং তার নিজের স্বার্থে, তার পরিবারের স্বার্থে, বাংলাদেশের স্বার্থে ও ভারতের স্বার্থে মুজিবের জীবন বাঁচাতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি না রাখাই ছিল ভারতের লক্ষ্য।’

ব্যানার্জী ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। তিনি তখন ‘ঢাকা’য় নিযুক্ত ছিলেন। আর ১৯৭১-১৯৭২ সালে তিনি লন্ডনে ভারতীয় একজন কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তখন তাকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গোপন কার্যভার দেওয়া হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার মুক্তি এবং তার প্রত্যাবর্তনে সহায়তা করা। পাকিস্তানও ঢাকায় তার পরাজয়ের পর একটি ব্যাপক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। তখন ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ক্ষমতা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছিল।

‘গোপন কূটনীতি বা গোয়েন্দা তৎপরতা’ ॥ পাকিস্তান সংকট নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি জরুরি অধিবেশনে যোগদানের জন্য ভুট্টো তখন নিউইয়র্কে অবস্থান করছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাক-হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের পর ইয়াহিয়া তাকে পিন্ডি ডেকে পাঠান আর তার ওয়াশিংটন-রাওয়ালপিন্ডি ফ্লাইট লন্ডনে বিরতি করার কথা ছিল।


ব্যানার্জীর মতে, ভুট্টোর দেশে ফেরা সম্পর্কে ‘গোপন সংবাদ’ পেয়ে গান্ধী তার যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার একটি জরুরি বৈঠক ডাকেন এবং ‘অতি জরুরিভাবে’ লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করতে পারে এমন একজন মাধ্যম খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।

তার উদ্দেশ্য ছিল ‘ভারত যে গোয়েন্দা তথ্যের সন্ধান করছে তা পাওয়া, আর তা হলো- পাকিস্তানের সামরিক আদালত কর্তৃক মুজিবুর রহমানকে মৃত্যুদ- দেয়ার বিষয়ে ভুট্টোর মনোভাব কী তা জানা।’
পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শেষ মুখ্য সচিব বা শীর্ষ বেসামরিক কর্মচারী মুজাফফর হোসেন সশস্ত্র বাহিনীর পরাজিত সদস্যদের সঙ্গে ভারতের একটি যুদ্ধবন্দী ক্যাম্পে ছিলেন।

তার স্ত্রী লায়লা হোসেন ছিলেন ভুট্টোর বান্ধবী। তিনি তখন লন্ডন সফরে ছিলেন। পাকিস্তান সংকটের কারণে দৃশ্যত তিনি সেখানে আটকে পড়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানি নেতার সঙ্গে তার (লায়লার) দীর্ঘ ঘনিষ্ঠ পরিচিতি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলেন। বেশ কিছু পাকিস্তানি নথিপত্র অনুযায়ী, ভুট্টো যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পথে লন্ডনে যাত্রাবিরতিকালে  লায়লার সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার বৈঠকে গান্ধী ‘যুদ্ধবন্দি’ হোসেনকে অবিলম্বে ভিআইপি অতিথি হিসেবে তার অন্যতম শীর্ষ সহযোগী ডিপি ধরের সরকারী বাসভবনে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন এবং তাকে লন্ডনে তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করেন।
ব্যানার্জী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর (ইন্দিরাগান্ধী) কার্যালয় এটি অনুমান করতে পেরেছিল যে হিথ্রো বিমানবন্দরে (লন্ডনে) ভিআইপি লাউঞ্জের আলকক অ্যান্ড ব্রাউন স্যুটে ভুট্টোর সঙ্গে একমাত্র ‘শীর্ষ বৈঠকে’ অংশ নিতে লায়লাকে ভাল অবস্থানে রাখতে হবে।  

ভুট্টোর লন্ডনে আসার ঠিক দুই দিন আগে ভিপি ধর ব্যানার্জীকে ফোনে লায়লাকে জানাতে নির্দেশ দেন যে ভুট্টো পাকিস্তানের নতুন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন এবং তিনি ইসলামাবাদে যাচ্ছেন।
ব্যানার্জী বলেন, ‘ভিআইপি বাহক’ হিসেবে তিনি তার পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে লায়লার সঙ্গে একটি ‘কার্যকর যোগাযোগ’ স্থাপন করেন। লায়লা খুব ভালভাবেই জানতেন যে এই ভারতীয় কূটনীতিক ভুট্টোর সঙ্গে তার পূর্ব অন্তরঙ্গতা সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন।

ব্যানার্জীর কাজটি ছিল লায়লাকে ভুট্টোর সঙ্গে হিথ্রোতে দেখা করে ‘দীর্ঘদিনের সম্পর্কের সূত্র ধরে’ তার স্বামীকে দিল্লি থেকে মুক্ত করার বিষয়টি ভুট্টোর কাছে উত্থাপন করতে রাজি করানো। ইন্দিরার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল-বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ভুট্টোর মনোভাব জানা।

ব্যানার্জী লিখেন, ভারত শুধু একটি জিনিস জানতে চেয়েছিল। আর তা হলো, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ভুট্টোর মনোভাব কি, তিনি কি তাকে দেশে ফিরে যাবার জন্য মুক্ত করবেন, নাকি মৃত্যুদ-ের জন্য সামরিক আদালতের কাছে হস্তান্তর করবেন।
ব্যানার্জী ভুট্টোর সঙ্গে লায়লার বৈঠকে তার স্বামী ও পাকিস্তানি অন্যান্য যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে জানতেও লায়লাকে অনুরোধ জানান।

ভারতীয় এই কূটনীতিক বলেন, তিনি তাদের মধ্যে বৈঠকটির আয়োজন করতে সফল হন এবং ‘দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্ন দুই বন্ধু যতটা সম্ভব অন্তরঙ্গভাবে আলোচনা করেন।

ব্যানার্জী লিখেছেন, নিঃসন্দেহে, তাদের মধ্যে এই সাক্ষাৎটি ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বৈঠকে পরিণত হয়। এটি ছিল সত্যিকার অর্থেই একটি রোমাঞ্চকর কাহিনী যা চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল।

লায়লা পরে তাকে বলেছিলেন যে, ভুট্টোর কাছে তার স্বামীর মুক্তির ব্যাপারে সহায়তার জন্য ‘আবেগঘন আবেদন’ জানালে, ভুট্টো তার আবেদনে সাড়া দেন।

লায়লা জানান, তিনি যখন ভুট্টোর কাছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়টি উত্থাপন করলেন, ভুট্টো তখন তাকে একপাশে টেনে ফিসফিস করে তাকে ‘ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও টপ সিক্রেট বার্তা দেন।’

লায়লাকে উদ্ধৃত করে ব্যানার্জী লিখেছেন, ‘লায়লা, আমি জানি তুমি কি চাও। আমি বুঝতে পারছি যে-তুমি মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষ থেকে একটি অনুরোধ নিয়ে এসেছ।’ এরপর ভুট্টো তাকে বলেন, ‘দয়া করে তার (ইন্দিরা) কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিও যে- দেশে ফিরে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই আমি মুজিবুর রহমানকে দেশে ফিরে যাবার জন্য মুক্তি  দেব।’

ব্যানার্জী লায়লার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেন যে, ভুট্টো তাকে বলেছিলেন, ‘বিনিময়ে আমি কি চাই, তা আমি অন্য চ্যানেলে ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়ে দেব। তুমি এখন যেতে পার।’

ভারতীয় কূটনীতিক বলেন, দু’জনের বৈঠকের ব্রিফিং পাওয়ার পর তিনি এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে, দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি গোপন বার্তা পাঠিয়ে লায়লা হোসেনের ইনপুটের বিষয়টি জানিয়ে দেন।

ব্যানার্জীর মতে, একটি অনানুষ্ঠানিক নেপথ্য মাধ্যম থেকে পাওয়া এই ‘ইতিবাচক বার্তাটি’ ইন্দিরা গান্ধীকে ‘অনেকটা আশাবাদী’ করে তোলে। তবে, তার মনে এটাও ছিল যে- ‘ভুট্টো কি ভারতকে বিভ্রান্ত করছেন? তিনি কি কোন খারাপ উদ্দেশ্যে এই মিথ্যা খবর ছড়াচ্ছেন?’

তিনি আরও লিখেছেন, কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিল্লি ইসলামাবাদ থেকে একটি বার্তা পায়। যাতে লায়লার কথাটির গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত হয় আর এই ক্ষেত্রে, ইন্দিরা তার নিজের হাতে বিষয়টি তুলে নেন।

কূটনীতিকের মতে, ভিন্ন চ্যানেল থেকে ইন্দিরা জানতে পারেন যে বঙ্গবন্ধু প্রথমে লন্ডনে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে তিনি ঢাকায় ফিরে যাবেন। ‘বঙ্গবন্ধু দিল্লি হয়েও ঢাকায় ফিরতে পারেন।’

ব্যানার্জী লিখেছেন, তিনি (ইন্দিরা) তার যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্যদের একজনকে একান্তে বলেছিলেন যে-বঙ্গবন্ধুর আসন্ন মুক্তির বিনিময়ে ভুট্টো তার কাছ থেকে কী চান সে সম্পর্কে এখন তার কাছে নিশ্চিত তথ্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্সের যে ফ্লাইটে লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা ফিরে আসেন ব্যানার্জীও এই বিমানের যাত্রী ছিলেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর - dainik shiksha শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি - dainik shiksha মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী - dainik shiksha আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই - dainik shiksha প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে - dainik shiksha জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ - dainik shiksha বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য - dainik shiksha এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা - dainik shiksha অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর - dainik shiksha ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন - dainik shiksha বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী - dainik shiksha একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030930042266846