রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) প্রথম টেস্টটিউব বেবির (শিশু) জন্ম হয়েছে। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় সি-ব্লকে মা ও প্রসূতি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে রিপ্রোডাকটিভ এন্ড্রোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ইনফার্টিলিটি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জেসমিন বানুর তত্ত্বাবধানে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে একটি মেয়ে টেস্টটিউব বেবির জন্ম হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে টেস্টটিউব নবজাতকের জন্মগ্রহণের মাধ্যমে আরেকটি সফলতার পালক যুক্ত হলো। টেস্টটিউব নবজাতক ও তার মা সুস্থ আছেন।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. জেসমিন বানু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে মা ও নবজাতক সুস্থ রয়েছে। কারও কোনো ধরনের সমস্যা নেই। আশা করছি দুয়েক দিনের মধ্যেই তাদের ছুটি দিয়ে দেব। বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে টেস্টটিউব বেবির জন্ম হচ্ছে। কিন্তু বিএসএমএমইউতে এটাই প্রথম।’
এ চিকিৎসক জানান, বিএসএমএমইউতে এ ধরনের চিকিৎসার জন্য প্রথমে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হয়। এ দম্পতির সে খরচটাই লেগেছে। বাকি কিছু ইনজেকশন ও ওষুধ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই দেওয়া হয়েছে। তবে দেশে বেসরকারিভাবে একটি টেস্টটিউব বেবির জন্ম দিতে গড়ে ৭-৮ লাখ টাকা খরচ হয়।
ইনফার্টিলিটি বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, বরিশালের বাসিন্দা এ নিঃসন্তান দম্পতি ১৩ বছর ধরে বন্ধ্যত্ব সমস্যায় ভুগছিলেন। আট বছর আগে তাদের বন্ধ্যত্ব শনাক্ত হয়। এই দীর্ঘ সময়ে এ দম্পতি বিভিন্ন জায়গায় বন্ধ্যত্ব সমস্যা নিরসনে চিকিৎসা নিলেও কোনো সফলতা পাননি। এমনকি আইভিএফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) পদ্ধতিতে যে টেস্টটিউব বেবির জন্ম হতে পারে, সে পরামর্শও পাননি। সবশেষে ২০২২ সালে বিএসএমএমইউর ইনফার্টিলিটি বিভাগে তাদের চিকিৎসা শুরু হয়।
চিকিৎসকরা আরও জানান, পরিপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে দম্পতির আইভিএফ উইথ আইসিএসআই (আইসিএসআই- ইন্ট্রা সাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইনজেকশন। এটি আইসিএসআই নামে পরিচিত, ডিমের সাইটোপ্লাজমে শুক্রাণু কোষকে ইনজেকশন দেওয়ার একটি কৌশল। এ কৌশলটি আইভিএফের একটি বিশেষ রূপ, যা পুরুষ-ফ্যাক্টর বন্ধ্যত্বের গুরুতর ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়) পদ্ধতিতে টেস্টটিউব বেবি প্রসবের সিদ্ধান্ত হয় ও স্টেম সেল থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে এ নবজাতকের মা গর্ভধারণ করেন এবং নিয়মিত চেকআপে থাকেন। ৩৮ সপ্তাহ পর গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় তিনি সন্তান প্রসব করেন।
প্রথম টেস্টটিউব নবজাতকের সিজারিয়ান সেকশনের সময় অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের শিক্ষক নার্সিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. দেব্রবত বণিক, ডা. মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, নিউন্যাটোলোজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান, রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রাইন অ্যান্ড ইনফার্টিলিটি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারজানা দীবা, সহযোগী অধ্যাপক (অনারারি) ডা. শাহীন আরাসহ ১৭ চিকিৎসক ও ৫ জন নার্স অংশ নেন।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রাইন অ্যান্ড ইনফার্টিলিটি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. জেসমিন বানু জানান, সাধারণত বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় ৫-১০ শতাংশ রোগীদের আইভিএফ পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনফার্টিলিটি বিভাগ চালু হয়। তার তত্ত্বাবধানে ২০১৯ সাল থেকে টেস্টটিউব বেবির আইভিএফ পদ্ধতি পুরোদমে চালু হয়। করোনাকালে এ সেবা কিছুটা স্থগিত থাকে। বর্তমানে এখানে বন্ধ্যত্বের সর্বাধুনিক চিকিৎসা স্টেম সেল থেরাপি, পিআরপি থেরাপি, রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি, এআরটি, আইইউআই ও আইভিএফ চিকিৎসা হচ্ছে।
চিকিৎসকরা জানান, ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে প্রথম একটি বেসরকারি হাসপাতালে টেস্টটিউব শিশুর জন্ম হয়। এরপর গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই প্রথম এ ধরনের শিশুর জন্ম হয়। এরপর গতকাল বিএসএমএমইউতে জন্ম হলো। বহু দম্পতি প্রতিবেশী দেশ ভারতে যান বন্ধ্যত্বের চিকিৎসার জন্য। দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বা ভারতে টেস্টটিউব শিশুর জন্য ব্যয় অনেক বেশি। ফলে বিএসএমএমইউতে এ সুযোগ তৈরি হওয়ায় এখন অনেক নিম্নবিত্ত দম্পতিও শিশু জন্মের সুযোগ পাবেন।