শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম একটি। সুশিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ প্রজন্ম তৈরি হয় যারা দেশ ও জাতির উন্নয়নে কাজ করে। শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শ নাগরিক গড়ে উঠে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে থাকে। সেই শিক্ষার ভিত যদি দুর্বল হয়, জাতিস্বত্তা বিরোধী হয়, নৈতিকতাহীন নিরেট বস্তুবাদী হয় তাহলে জাতি ভুল পথে পরিচালিত হয়। আদর্শ শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়তে যেভাবে দেশের মানুষের বোধ-বিশ্বাস, ধর্মীয় আদর্শের প্রতি লক্ষ্য রেখে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার দরকার ছিলো, কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, স্বাধীনতার ৫২ বছরেও শিক্ষা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সুচিন্তিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কখনোই সেভাবে লক্ষ্য করা যায়নি। শিক্ষা খাতে বার্ষিক বাজেট সবচেয়ে কম। শিক্ষকদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত। অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনা কতটা নাজুক তা শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর দিকে তাকালে তার সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তাছাড়া বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা বিকশিত হবার পরিবর্তে অনেকেই নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, বাড়ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, এমতাবস্থায় নীতি-নৈতিকতার প্রধান চালিকাশক্তি ধর্মীয় শিক্ষাকে পরিকল্পিতভাবে সংকুচিত করাসহ নানারূপ অসঙ্গতিপূর্ণ বিতর্কিত কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে, যেটি ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত। এরপর ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে মজিদ খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে এম.এ. বারী শিক্ষা কমিশন, ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশন এবং সর্বশেষ ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। শিক্ষা কমিশনের জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রয়োগ ও বাতিল দেখতে দেখতে জাতি আজ ক্লান্ত ও গভীর উদ্বিগ্ন। সর্বশেষ ভিনদেশের শিক্ষাক্রম অনুকরণ করে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন জাতির সঙ্গে উপহাস বৈ কিছু নয়। কারণ ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে সংসদে পাস হওয়া জাতীয় শিক্ষানীতির সঙ্গে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার বাস্তবে কোনো মিল নাই। সরকার জাতিকে তথ্য দেয় এক রকম কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। তাই সাবেক কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন ‘সংসদে আলোচনা ছাড়াই নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা হয়েছে’ (দৈনিক শিক্ষা)। এটি একটি স্বার্থান্ধ জ্ঞানপাপী চক্রের ষড়যন্ত্র। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. মোঃ কামরুল হাসান মামুন তার ফেসবুক পেজে বলেন-‘নতুন শিক্ষাক্রমের পক্ষে যারা বলছেন তাদের সবাই হয় এই সরকারের দলদাস না হয় সুবিধাভোগি আর না হয় সুবিধা-প্রার্থী,’ তিনি আরো বলেন ‘মন্ত্রী, আমলা এবং দলীয় বড় নেতাদের মধ্যে যারা এই নতুন কারিকুলামের ভূয়সী প্রশংসা করছেন তাদের একজনের সন্তানও নতুন কারিকুলামে বা বাংলা মাধ্যমে পড়ছে না।’ এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পরনির্ভরশীল করার ষড়যন্ত্রকারীরা জানেন এই কারিকুলামে পড়ালেখা করে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং বাংলার কৃষকের সন্তানেরা অর্থাৎ ৯০ শতাংশ জনগণের সন্তানরা শ্রমিক ও কেরানী ছাড়া আর কিছুই হতে পারবে না। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ, যোগ্য, নৈতিকতাসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে কোন সরকারই আন্তরিক ভূমিকা পালন না করে, বার বার শিক্ষাখাতকে বিতর্কের দিকে ঠেলে দিচ্ছে যার ফলে আজও দেশের মানুষ শিক্ষাব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে শংকিত।
কয়েক বছর পূর্বে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে নতুন কিছু করার প্রচেষ্টা চালানো হলেও সেটা কার্যত ব্যর্থ। তবে কেন ব্যর্থ হলো সেটার যৌক্তিক বিশ্লেষণ করা হয়নি। ‘ইউনেস্কো’ কর্তৃক শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৫.৫ শতাংশ বরাদ্দের পরামর্শ থাকলেও বাংলাদেশ সরকার দেয় ১.৭৬ শতাংশ যা পৃথিবীতে শিক্ষায় কম বরাদ্দ দেয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এরমধ্যে আবার প্রতিনিয়ত কারিকুলাম পরিবর্তনের নামে শিক্ষাব্যবস্থার মতো এত গুরত্বপূর্ণ একটি খাতের বাজেটের অপব্যবহার করা হয়েছে। শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ না দিয়ে, এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করে জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ বাস্তবায়ন করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে না বলেই সচেতন শিক্ষাবিদদের অভিমত।
এমতাবস্থায় আমরা ‘‘জাতীয় শিক্ষক ফোরাম’’ জাতীয় চেতনা ও দায়িত্ববোধ থেকে নতুন কারিকুলাম এর বাস্তবতা এবং স্পর্শকাতর মূল সংকটগুলো তুলে ধরছি-
১.বাস্তবায়নে অনুপযোগীঃ- বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা; পরিবেশগত কারণ; শিক্ষা পদ্ধতির ধরণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানসম্মত অবকাঠামোগত ঘাটতি এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে এ কারিকুলাম দেশের জন্য বাস্তবায়ন উপযোগী নয়।
২.বিজ্ঞান শিক্ষার সংকোচনঃ- প্রস্তাবিত শিক্ষা কারিকুলামে বিজ্ঞান শিক্ষার মারত্মক সংকোচন দৃশ্যমান। জীবনজীবিকা, স্বাস্থ্যশিক্ষা, শিল্পসংস্কৃতি ও তথ্যপ্রযুক্তির মতো চার-চারটা বিষয়ের পৃথক পাঠ্যবই থাকবে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত, অথচ ফিজিক্স-ক্যামিষ্ট্রি-বায়োলজি মিলিয়ে একটা মিক্সার থাকবে ৯ম-১০ম শ্রেণিতে সবার পড়ার জন্য, আর কোনো অপশন থাকবে না। অপশনগুলো খোলা রেখেই এটা করা যেতো কিন্তু তা করা হয়নি। এই কারিকুলাম বাস্তবায়িত হলে বৈশ্বিক মানদণ্ডে পেশা ভিত্তিক জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হবে।
৩.ধর্ম শিক্ষাকে চূড়ান্তভাবে উপেক্ষা করা হয়েছেঃ- ধর্ম শিক্ষা মানুষকে নীতি-নৈতিকতা শেখায়। স্রষ্টার পরিচয় লাভ হয় অথচ নতুন কারিকুলামে ধর্ম শিক্ষাকে নানাভাবে সংকুচিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। ধর্মীয় পরিচয়ে এদেশের সন্তানরা বেড়ে উঠে। সেজন্য ধর্ম শিক্ষাকে আরো গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার সর্বস্তরে বাধ্যতামূলক করার কথা থাকলেও উল্টো মাধ্যামিক স্তরে পাবলিক পরীক্ষা থেকে ধর্ম শিক্ষা বাদ দেয়া হয়েছে। সংকুচিত ও উপেক্ষিত ধর্মশিক্ষার কারণে ধর্মহীন প্রজন্ম গড়ে উঠবে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। যার কারণে আগামী প্রজন্ম ধর্মহীন-খোদাদ্রোহী হিসেবে গড়ে উঠবে। যা সংবিধান তথা শিক্ষানীতি-২০১০ এর ৭ অধ্যায়ে উল্লেখিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পরিপন্থীও বটে। ধর্মীয় শিক্ষাকে সংকুচিত করার হীন চিত্রগুলো এতটা ব্যাপক যেগুলো এখানে যুক্ত করলে প্রবন্ধের কলেবর অনেক বৃদ্ধি পাবে তাই এ বিষয়ে সামান্য কিছু তথ্যপ্রমাণ আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি।
ক. ২০২২ শিক্ষাবর্ষে ইবতেদায়ী প্রথম শ্রেণির ইংলিশ ফর টু ডে বইয়ের ২য় পৃষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের পরস্পর কথোপকথনের সময় সালাম বিনিময় ছিলো কিন্তু, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে সালাম মুছে ফেলে সেখানে ‘গুড মর্নিং’ শব্দ দেয়া হয়েছিলো এবং ২০২৪ শিক্ষাবর্ষেও তা অপরিবর্তীত রাখা হয়েছে।
খ. ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বই এর ৩৯ পৃষ্ঠায় দেশিয় সংস্কৃতির নামে মঙ্গল শোভাযাত্রা আর ঢোল-তবলা উপস্থাপন করা হয়েছে।
গ. ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের নবমশ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১১০ পৃষ্ঠায় ইসলামের বিধান একাধিক বিবাহকে অন্ধকার প্রথা হিসেবে বলা হয়েছে।
ঘ. এছাড়া ৭ম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বই; ১৮ পৃষ্ঠা, ৯৫ ও ৯৬ পৃষ্ঠা, চতুর্থ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়; ৮৪ পৃষ্ঠাসহ অনেক ক্ষেত্রেই ডিইসলামাইজেশন করা হচ্ছে।
ঙ. ৬ষ্ঠ শ্রেণির (স্কুল ও দাখিল মাদরাস) স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ১২ পৃষ্ঠায় ‘স্ট্যান্ডিং এলবো টু নী ক্রানসেজ’ নামক ব্যায়াম এর পদ্ধতি শিখাতে গিয়ে মেয়েদের ৩ টি দৃষ্টিকটু ছবি ব্যবহার করা হয়েছে যা অন্যান্য ধর্মতো বটেই ইসলাম ধর্মের শালীন পোশাক এর বিপরীত চিত্র প্রকাশ করেছে। সচেতন অভিভাবক কোনভাবেই এটা মেনে নিতে পারেননি।
চ. ৬ষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৯৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে যে, ‘‘আমার মা কপালে চুমু দিলেও, আমি হয়ত আমার বন্ধুকে চুমু দিতে দিবো না। তবে সে একই বন্ধুর সঙ্গে হাত ধরে ঘুরতে হয়তো আমার অস্বস্তি লাগবে না।’ এখানে মেয়ে নাকি ছেলে বন্ধু তা উল্লেখ করাতো হয়নি আবার চুমু খেতে হয়ত না দিলেও হাত ধরে ঘুরতে বের হতে তেমন বাঁধা নেই। আজকে সমাজে অসংখ্য কিশোর কিশোরী পিতা মাতার অজান্তে বন্ধুর হাত ধরে নিখোঁজ থেকেছে এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এটা বাংলাদেশের সভ্য সমাজকে পশ্চিমাদের মত অসভ্য অবাধ যৌনতার সমাজে পরিণত করার কূটকৌশল বৈ কিছুই নয়।
৪.ট্রান্সজেন্ডার প্রমোট: সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৩৯ থেকে ৪৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত শরিফার গল্প আলোচনা করা হয়েছে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে উক্ত বইয়ে যে বিষয়টি নিয়ে সারা দেশব্যাপী প্রকৃতিবিরুদ্ধ ও দেশীয় সংস্কৃতি বিরোধী ট্রান্সজেন্ডার প্রমোট করায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিলো। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে না নিয়ে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দেও ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টি বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ট্রান্সজেন্ডার কে তালগোল পাকিয়ে পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত সমকামিতা বিষয়টিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সম্প্রতি সিলেট থেকে এক মহিলা সমকামী অপর মহিলাকে বিবাহ করার জন্য সাতক্ষীরায় গিয়েছিলো। অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ফরমে ট্রানজেন্ডার কে সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। নতুন কারিকুলামের ছদ্মাবরণে একটি স্বার্থান্বেষী মহল হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত পারিবারিক প্রথার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে।
৫.বিজ্ঞানের নামে অবৈজ্ঞানিক বিবর্তনবাদ প্রমোটঃ ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের ৭ম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের ৪র্থ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘যে জীবগুলো সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত ও অভিযোজিত হয়ে হয়ে একে অপরের থেকে এতটাই আলাদা হয়ে গেছে যে, সেগুলো আর একে অপরের সঙ্গে প্রজননে অংশ নিতে পারে না, সেগুলোর আলাদা প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়’ যা বিবর্তনবাদের মূল কথা। যদিও এ বিবর্তনবাদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে এবং অনেক দেশেই বিবর্তনবাদের থিওরি বাতিল করা হয়েছে। দেশের জনগণের ধারাবাহিক আন্দোলন প্রতিবাদের পরও বিবর্তনবাদের মতো অবৈজ্ঞানিক মতবাদ প্রমোট আমাদেরকে হতবাক করেছে।
৬.মাদরাসা (আলিয়া) শিক্ষার স্বকীয়তা বিরোধী কারিকুলাম: এই কারিকুলাম একমুখী হওয়ায় জেনারেল সাবজেক্টগুলো হুবহু স্কুল শিক্ষার সিলেবাস থেকে মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যবই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাঠ্যবইগুলোর বিভিন্ন জায়গায় এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা মাদরাসা শিক্ষার বোধ-বিশ্বাসের বিপরীত। মাদরাসা শিক্ষার্থী শুধু নয় বরং স্কুল পড়ুয়া মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্যও এটা বোধ- বিশ্বাসের বিপরীত।
৭.স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার নামে যৌন শিক্ষা: ষষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৪৭ থেকে ৪৯ পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে নারী পুরুষের দেহের পরিবর্তন, নারী-পুরুষের শরীর থেকে কী নির্গত হয়, কোন অঙ্গের আকার কেমন হয়, এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কেমন আকর্ষণ হয় তা খোলামেলাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে পাঠদানে শিক্ষকরা বিব্রতবোধ করছেন। একই শ্রেণির বিজ্ঞান ও অনুসন্ধানী পাঠ এর ১০ম অধ্যায় ‘মানব শরীর’ শিরোনামে ১১১ থেকে ১১২ পৃষ্ঠায় নারী-পুরুষের গোপনীয় অঙ্গগুলো সম্পর্কে খুব খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে, যা খুবই উদ্বেগের বিষয়। যা ১১ থেকে ১৩ বছরের কোমলমতি শিশু মনে ভয়ংকর কুপ্রভাব পড়ছে। পাঠ্য বইয়ের বিষয় নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রুপ ডিসকাশন করতে হয়, গ্রুপ এসাইনমেন্ট করতে হয়, এবং সামগ্রিক মূল্যায়নের মাধ্যমে ত্রিভুজ পেতে হয়, এভাবে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আলোচনার মাধ্যমে লজ্জার বাঁধন উঠে যাবে এবং যেকোনো অনৈতিক কাজে তাদের অনায়াসে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
৮.দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব:- বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানসম্মত শিক্ষা। এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদী (৬ মাস থেকে ১ বছর) প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। ৫ থেকে ৭ দিনের একটি ট্রেনিং সেশন শেষে শিক্ষকদের ক্লাসরুমে পাঠানো হয়েছে। চলমান শিক্ষাক্রমে পাঠদান করার মত দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ উপলদ্ধি করার মতো শিক্ষকের অভাব রয়েছে। ফলে পাঠদান পদ্ধতি সমালোচিত ও হাস্যকর হিসেবে প্রমাণিত হবে।
৯.দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বিরোধীঃ- প্রস্তাবিত শিক্ষার রূপরেখায় বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বোধ-বিশ্বাস, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ইত্যাদি উপেক্ষা করা হয়েছে, ফলে ভিনদেশী সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের মনোজগতে তীব্র প্রভাব বিস্তার করবে। পাশ্চাত্যের প্রচলিত আদর্শিক মূল্যবোধ বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক পদস্খলন রীতিমত আঁতকে ওঠার মত।
১০.ব্যয় বহুল ও বৈষম্যের রূপরেখাঃ- বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি নির্ভর আমাদের অর্থনীতি। অথচ চলমান শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয়ভার অনেক বেশি। এর ফলে শহরে ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের মাঝে বৈষম্য দেখা দেবে। যার কারণে দেশে শিক্ষাগত বৈষম্য বেড়ে যাবে এবং পূর্বের তুলনায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার আরো বৃদ্ধি পাবে।
১১.পড়াশুনা বিমুখ কারিকুলামঃ- পাঠদান পদ্ধতির জটিলতার কারণে এই কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা বিমুখ করবে ফলে শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষাহীন রেখে দেবে।
১২.জটিল মূল্যায়ন পদ্ধতি ও পরীক্ষাহীন কারিকুলামঃ- মুখস্থ বিদ্যা বন্ধের অজুহাতে এই কারিকুলাম দীর্ঘ সময় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার বাহিরে রাখা হয়েছে। হঠাৎ করেই পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে গ্রুপ ভিত্তিক মূল্যায়ন ও মূল্যায়নে আনা হয়েছে ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভূজ যা শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের পক্ষপাতদুষ্ট ও নৈতিক পদঙ্খলনের আশংকা রয়েছে।
১৩.অনলাইন নির্ভর শিক্ষায় শিশু-কিশোরদের চারিত্রিক বিপর্যয় : এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে অনলাইন ব্যবহার সীমিত করার পরিবর্তে ব্যাপক করা হয়েছে। কোমলপ্রাণ শিশু-কিশোররা বিভিন্ন ডিভাইস (মোবাইল, ট্যাব) ইত্যাদি ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নিষিদ্ধ গেমস, অনলাইন জুয়া, ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, পর্ণ সাইটসহ নানা অপকর্মের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তৈরি হয়েছে কিশোর গ্যাং যারা ছিনতাই, খুনে জড়িত হয়ে পড়ছে। যৌন হয়রানি, ইভটিজিং, কিশোর-কিশোরীর অবৈধ যৌন সম্পর্ক, নেশা, মাদকসহ নানা কাজে নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। অতএব অনলাইন নির্ভর এই কারিকুলাম অভিভাবকসহ সচেতন মহল কোনভাবেই গ্রহণ করতে পারছেন না। একটি পঙ্গু ও চরিত্রহীন আগামী প্রজন্ম আমরা চাই না। আমরা চাই, শিশু-কিশোরদের অনলাইন নির্ভরতা কমিয়ে পাঠ্যবই নির্ভর আগামী প্রজন্ম।
১৪.একমুখী শিক্ষা, নিম্নমানের জনশক্তি ও বেকারত্বের সৃষ্টিঃ- এই কারিকুলাম একমুখী শিক্ষা হওয়ার ফলে বহুমুখী শিক্ষা হারিয়ে যাবে। আবার এই কারিকুলামের কারণে বুদ্ধিদীপ্ত, উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল প্রজন্ম তৈরি বাধাগ্রস্ত হবে এবং দেশে বেকারত্বের সৃষ্টি হবে।
উপরোক্ত স্পর্শকাতর সংকটগুলোর কারণে, দেশের স্বার্থে এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের মেধা বিকাশের স্বার্থে আমরা জাতীয় শিক্ষক ফোরামের পক্ষ থেকে নিচের দাবিগুলো উপস্থাপন করছি।
১. পাঠ্য পুস্তকের সকল বিষয় হতে বিতর্কিত ও ইসলামী আকিদা বিরোধী প্রবন্ধসমূহ বাদ দেয়া। স্কুল ও মাদরাসার সকল পাঠ্যপুস্তকে অনৈসলামিক শব্দ এবং অশ্লীল চিত্রমুক্ত রাখা।
২. ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তি স্ব-স্ব ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী এবং পাঠ্যপুস্তকের নামকরণ নিজ ধর্মের নাম অনুসারে করা।
৩. মাদরাসা শিক্ষার কারিকুলাম, শিক্ষানীতিমালা-২০১০ অনুযায়ী মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট আলেম, দ্বীনদার ইসলামীক স্কলার শিক্ষকদের দ্বারা পরিমার্জন করা ও আলীয়া মাদরাসার স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বতন্ত্র কারিকুলাম প্রণয়ন করা।
৪. নৈতিকতা সমৃদ্ধ জনশক্তি তৈরির লক্ষে সকল ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ নিজ ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৫. পূর্বের ন্যায় নবম শ্রেণি হতেই বিভাগ বিভাজনের পদ্ধতি বলবৎ রাখা এবং বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক বইসমূহ পৃথক রাখা।
৬. প্রকৃতিবিরুদ্ধ ও দেশীয় সংস্কৃতি বিরোধী ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ পাঠ্যপুস্তক থেকে বাতিল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির কোটা থেকে ট্রান্সজেন্ডার বাতিল করা।
৭. পাঠ্য সিলেবাসে দেশ, জাতিস্বত্বা ও ইসলামী তাহযীব, তমুদ্দুন বিরোধী সকল অসঙ্গতি দূর করা।
৮. শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও শিক্ষক সুরক্ষা আইন তৈরির মাধ্যমে উপযুক্ত বেতন এবং মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করা।
৯. শিক্ষার সকল ব্যয়ভার রাষ্ট্রকর্তৃক বহন করা এবং ইবতেদায়ী মাদরাসাসহ সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা।
১০. কারিকুলামের অসঙ্গতির কথা বলতে গিয়ে যে সকল শিক্ষক ও অভিভাবকদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দেয়া।
১১. প্রতি শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করা।
উপরোক্ত স্পর্শকাতর সংকটগুলোর কারণে, দেশের স্বার্থে এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের মেধা বিকাশের স্বার্থে আমরা জাতীয় শিক্ষক ফোরামের পক্ষ থেকে নিচের দাবিগুলো উপস্থাপন করছি।
১. ইসলামোফোবিয়া ও ইসলাম সম্পর্কিত ভুল ইঙ্গিতমূলক রচনা ও বিষয়বস্তুসমূহ পরিহার করতে হবে এবং স্কুল মাদরাসার সকল পাঠ্যপুস্তকে অনৈসলামিক শব্দ ও অশ্লীল চিত্রমুক্ত রাখতে হবে।
২. শিক্ষকদের স্বতন্ত্র উচ্চতর বেতন কাঠামো এবং শিক্ষক সুরক্ষা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মেধাবীদেরকে শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে।
৩. পূর্বের ন্যায় নবম শ্রেণি হতেই বিভাগ বিভাজনের পদ্ধতি বলবৎ রাখতে হবে এবং বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
৪. দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণে যথাযথ কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে।
৫. শিক্ষার সকল ব্যয়ভার রাষ্ট্রকর্তৃক বহন করা এবং ইবতেদায়ী মাদরাসাসহ সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে হবে।
৬. প্রকৃতি বিরুদ্ধ ও দেশীয় সংস্কৃতি বিরোধী ট্রান্সজেন্ডারের অনুকূলে যে সব বিষয় ও বক্তব্য রয়েছে তা পাঠ্যপুস্তক থেকে পরিহার করা এবং সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির কোটা থেকে ট্রান্সজেন্ডার বাতিল করতে হবে।
৭. যৌন শিক্ষার নামে আপত্তিকর ভাষা যেভাবে খোলামেলা বর্ণনা করা হয়েছে তা শিক্ষক শিক্ষিকারা পাঠদানে বিব্রতবোধ করছেন। সুতরাং যৌন শিক্ষার অপ্রয়োজনীয় ও বিপদজনক দিকসমূহ পরিহার করতে হবে।
৮. মাদরাসা শিক্ষার কারিকুলাম শিক্ষা নীতিমালা-২০১০ অনুযায়ী মাদরাসা সংশ্লিষ্ট দ্বীনদার ইসলামীক স্কলার দ্বারা পরিমার্জন করতে হবে এবং আলীয়া মাদরাসার স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বতন্ত্র কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে।
৯. ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তি স্ব-স্ব ধর্মগ্রন্থের আলোকে হতে হবে এবং পাঠ্যপুস্তকের নামকরণ নিজ নিজ ধর্মের নাম অনুসারে করতে হবে।
১০. কারিকুলাম বাস্তবায়নের অসংঙ্গতির কথা বলতে গিয়ে যে সকল শিক্ষক ও অভিভাবকদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদেরকে অনতিবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।
১১. প্রতি শ্রেণিতে রেজিষ্ট্রেশন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।
১২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা-পর্ষদ এর সদস্যদের নূন্যতম শিক্ষাগত ও অন্যান্য যোগ্যতা নির্ধারণ করতে হবে।
১৩. উপরোক্ত দাবিসমূহের আলোকে বিতর্কিত শিক্ষা কারিকুলাম ২০২১ বাতিল করে যুগোপযোগি শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নে অভিজ্ঞ, দেশপ্রেমিক ও দ্বীনদার শিক্ষাবিদদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক নাছির উদ্দীন খান, কেন্দ্রীয় সভাপতি, জাতীয় শিক্ষক ফোরম
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।